অঘ্রানের কৃষ্ণ অষ্টমীতে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, দুই মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামে ঘরোয়াভাবেই বেশ সাড়ম্বরে পালিত হয় অন্যতম এক লোক-পার্বণ, যার নাম, 'পুড়হা পরব'।
পুড়হা পরবে বাপ-মায়ের প্রথম সন্তান, সে ছেলে হোক বা মেয়ে, তার জন্য পুজো দেওয়া হয় ইষ্ট দেবতা বা গৃহদেবতার কাছে, তার সমৃদ্ধি কামনা করা হয়, তাকে প্রদীপ-থালায় বরণ করা হয়, নতুন বস্ত্র দেওয়া হয়, আশীর্বাদ জানানো হয় সুস্থ ও সুদীর্ঘ জীবনের।
বাঁকুড়ায় পুড়হা পরবের দিন সকাল থেকেই জ্যেষ্ঠ সন্তানকে উপোষ দিয়ে থাকতে হয়। পার্বণ উপলক্ষে তৈরি হয় চালের গুঁড়োর পিঠে। 'কাখরা' ও 'গড়গড়িয়া'। প্রথমটা ঘিয়ে ছাঁকা, দ্বিতীয়টি জলে সেদ্ধ। দু'য়ের ভেতরেই থাকে ক্ষীরের পুর। আর তৈরি হয় আতপ চালের পায়েস। আতপের ভাত। সঙ্গে থাকে গাওয়া ঘিয়ে রাঁধা পঞ্চব্যঞ্জন আর ডাল। এছাড়া তার সঙ্গে অবশ্যই অবশ্যই থাকে পুনকা শাক ও বেগুন পোড়া। 'পুড়হা পরবে' গৃহদেবতাকে নিবেদন করে তারপর জ্যেষ্ঠ সন্তানকে খাইয়ে গেরস্তের ঘরে বছরভরের জন্য বেগুন পোড়া খাওয়ার শুভ সূচনা হয়। কারণ, অঘ্রান মাস বহু পুরাতন পঞ্জিকায় ছিল বছরের প্রথম মাস।
যাই হোক, এ-অঞ্চলের ব্রাহ্মণদের ইষ্ট বা গৃহদেবতা ভিন্ন ভিন্ন নামে বিষ্ণুই। তাঁকে পুজোর পর, প্রথা মতো ভোগ নিবেদনের পর নতুন কাপড় পরে পূজারি ও দেবতার সম্মুখে এসে বসে জ্যেষ্ঠ সন্তান। পূজারি তার কপালে চন্দনের ফোঁটা এঁকে দেন। প্রদীপ-থালায় আরতি করে তাকে বরণ করেন। তারপর সেই জ্যেষ্ঠ সন্তান সাষ্টাঙ্গে দেবতাকে প্রণাম করে। দেবতার আশীর্বাদ নেয়। তখন গুরুজনেরা তাকে হলুদ-আতপ দিয়ে আশীর্বাদ করতে শুরু করেন। সেই মুহূর্তে গেরস্তের ঘর ভরে ওঠে শঙ্খ-উলু মন্ত্র ও মঙ্গলধ্বনিতে...
এই যে প্রথম সন্তানকে এভাবে বিশেষিত করে এ-দিন পার্বণ পালন করা হয়, তার কারণটা কী? বিস্তারিত আলোচনায় আসুন বিষয়টা স্পষ্ট করি:
দু'তিনশো বছর আগে উৎকল প্রদেশ থেকে অসংখ্য ব্রাহ্মণ বর্ণের মানুষ বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলে এসে বন কেটে বসত গড়ে বাস করতে থাকেন। উৎকল প্রদেশ থেকে এসেছিলেন বলে এঁরা এখানকার আদি অধিবাসী ও অন্যান্য স্থান থেকে এই সব অঞ্চলে বাস করতে আসা মানুষের কাছে পরিচিত হয়েছিলেন 'উৎকল ব্রাহ্মণ' নামে। যাই হোক, উৎকল প্রদেশ (ওড়িশা) থেকে এঁরা নিজেরা যেমন এসেছিলেন, তেমনি সঙ্গে করে এনেছিলেন নিজস্ব কিছু খাদ্যাভ্যাস, রীতিনীতি ও পার্বণ। তারই একটি হল 'পুড়হা পরব'।
পুড়হা পরবের সঙ্গে ব্যাপকভাবে মিল রয়েছে ওড়িশার জনপ্রিয় লোকপার্বণ 'প্রথমাষ্টমী'র। 'মিল' না-বলে বরং বলা ভালো ওড়িশার পার্বণটিই এখানে এসে হয়েছে 'পুড়হা পরব'। কারণ, ওড়িয়া শব্দ 'পড়ুয়ান' মানে, 'প্রথম সন্তান'। 'পড়ুয়ান'-কেন্দ্রিক এই পরবটিতে সরাসরি 'পড়ুয়ান' শব্দটিকে গুরুত্ব দিতে প্রথমে হয়তো 'প্রথমাষ্টমী'-কে এখানে 'পড়ুয়ান পরব' বলে ডাকা শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে লোকমুখে ও অপভ্রংশে তাই-ই হয়ে উঠেছে, 'পুড়হা পরব'।
ওড়িশায় 'প্রথমাষ্টমী' লোকসমাজে কবে প্রচলিত হয়েছে তা জানা যায় না। তবে চোদ্দ শতক থেকে যে তা ব্যাপকভাবে বৃহত্তর জনসমাজে গৃহীত হয়েছে, সেটা জানা যায়।
উৎকল প্রদেশ থেকে এখানে এসে 'উৎকল ব্রাহ্মণ'রা পার্বণটিকে যেমন নিজেদের মতো করে নাম দিয়েছেন, তেমনি তার রীতিনীতিতেও কিছু হেরফের ঘটিয়েছেন। যেমন:
ওড়িশায় প্রথম সন্তানটির বয়স এক বছর হলেই তার 'প্রথমাষ্টমী' পালিত হয়। কিন্তু আমাদের এখানে সন্তানের বয়স কমপক্ষে পাঁচ বছর হতেই হবে। এই পাঁচ বছর বয়সে কোন কারণে 'পুড়হা' পালন করতে (এখানে 'পুড়হা পালন'কে বলা হয়, 'পুড়হা বসানো') না-পারলে সাত-নয়-এগারো ইত্যাদি বিজোড় বয়সে পালন করতে হয়। কিছুতেই জোড় সংখ্যার বয়সে শুরু করা যায় না। নিয়ম মেনে একবার পালন শুরু হয়ে গেলে ফি-বছর তা আমৃত্যু চলতে থাকে।
ওড়িশায় 'প্রথমাষ্টমী'র জন্য নতুন বস্ত্র, মিষ্টি ইত্যাদি উপঢৌকন প্রতি বছর মামাবাড়ি থেকে আসে। কিন্তু, আমাদের এখানে প্রথম বছর শুধু মামাবাড়ি থেকে আসে, পরবর্তীতে বাড়ি থেকেই দিতে হয়।
মামাবাড়ি থেকে উপঢৌকন আসার এই বিষয়টি এবং এই পার্বণটি কেন অঘ্রানের কৃষ্ণ অষ্টমীতে পালিত হয়, তাই নিয়ে ওড়িশায় একটি কিংবদন্তি চলিত আছে। সেটি হল:
কৃষ্ণ ও বলরাম যখন বৃন্দাবন থেকে মথুরায় এসে প্রথমবার মামা কংসের বাড়িতে উঠলেন, তখন নতুন বস্ত্র পরে প্রদীপ-থালায় বরিত হয়ে অভ্যর্থিত হয়েছিলেন। আপ্যায়িত হয়েছিলেন বহুবিধ মিষ্টান্ন, পিষ্টক প্রভৃতি সহযোগে। বলরাম যেহেতু বড়, তাই তিনি ছিলেন সর্বাগ্রে। সুতরাং, তিনিই প্রথম অভ্যর্থিত ও আপ্যায়িত হয়েছিলেন। ঘটনাটি ঘটেছিল অঘ্রানের কৃষ্ণ অষ্টমী তিথিতে। আর এই ঘটনা স্মরণ করতেই নাকি 'প্রথমাষ্টমী' তথা 'পুড়হা পরব'-এর উৎপত্তি হয়েছে।
পুরাণ হোক বা কিংবদন্তি, সে-সব পেরিয়ে ব্যবহারিক জীবনে এই প্রথম সন্তানকে বরণ ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য পার্বণ গড়ে তোলা ও তাকে বয়ে নিয়ে চলার কারণটি কী, তা বিচার করে দেখতে গিয়ে অনেকেই মনে করেন যে, এই পার্বণের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর প্রথম সন্তানকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় সংসারের প্রতি তার বিরাট দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা। পিতা-মাতার পরেই সংসারে যে তার স্থান ও সম্মান, সেই কথা। পিতা-মাতা বিগত হলে সংসারের দায়িত্ব তার ওপরেই বর্তাবে, অনুজেরা তাকে পিতা-মাতার সম্মান দেবে, সকলের কাছে এটা প্রতিষ্ঠা করার পার্বণই 'পুড়হা পরব'।
তবে আমাদের মনে হয় যে, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে শুধু দায়িত্ব মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এ-অনুষ্ঠান বা পার্বণ হত এমনটা মনে করার তেমন কোন কারণ নেই। কেননা, মাতৃতান্ত্রিক সমাজের পতন হয়েছে কয়েকশো বছর আগে। সেক্ষেত্রে প্রথম সন্তান মেয়ে হলে তাকে সম্মান বা বরণ করার ঐতিহ্য পুরুষতন্ত্রের প্রবল প্রবাহে বজায় থাকত না।
কারণ, কয়েকশো বছর ধরে মেয়ে জ্যেষ্ঠ সন্তান হলেও তার হাতে তো কোন ক্ষমতাই ছিল না। পুরুষতন্ত্রে পরিবারের বড় পুরুষের (সে কন্যাসন্তানের অনুজ হলেও) হাতে এমনিতেই সংসার পরিচালনার ক্ষমতা এসে যেত বা যায়। ফলে আলাদা করে তাকে বিশেষিত করার কোন অভিপ্রায় মনে হয় এই পার্বণের নেই, ছিলও না কোনদিন।
বরং বলা যায়, প্রথম সন্তান, সে ছেলেই হোক বা মেয়ে; সে-ই তো বাপমায়ের ঘর প্রথম আলো করেছে, সমাজের কাছে সে-ই তো প্রথম প্রমাণ করেছে তার বাপমা বন্ধ্যা নয়, সে-ই তো বাপমাকে দিয়েছে সন্তানসুখের প্রথম আস্বাদ; এ-যে কতবড় মধুর প্রাপ্তি, তা একমাত্র বাপমা বা পরিবারই অনুভব করতে পারেন। এদিক থেকে 'প্রথমাষ্টমী' হোক বা 'পুড়হা পরব', আসলে তা সেই মধুর স্মৃতিরই উদযাপন, তা সেই মধুর প্রাপ্তিরই লালনধারা। আর ওই সব ক'টি প্রাপ্তির জন্য এই পার্বণ আসলে সেই প্রথম সন্তানের কাছে বাপমায়ের কৃতজ্ঞতা স্বীকার, পরিবারের ঋণস্বীকার।
বাঁকুড়া, পুরুলিয়াতে এই পার্বণ শুধুমাত্র 'উৎকল ব্রাহ্মণ'দের পার্বণ হয়েই রয়ে গেছে। কিন্তু দুই মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম উৎকল লাগোয়া হওয়ায় ওড়িশার 'প্রথমাষ্টমী'র বর্ণ নির্বিশেষ সর্বজনীনতা বজায় রাখতে পেরেছে। সেখানেই তার জয়। কারণ, লিঙ্গভেদের ঊর্ধ্বে উঠে বর্ণ-নির্বিশেষ হওয়াতেই তো একটি পার্বণের সার্থকতা। যেখানে সেটা হয়, সেখানেই ওড়ে তার জয়ধ্বজা...