‘মঙ্গল’ মানে শুভ। চণ্ডী, দেবী দুর্গার এক রূপ। বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে দূর্গার এই রূপের পুজো হয়ে থাকে। বারোমাস মঙ্গলবার দেবী মঙ্গল চণ্ডীর পুজো হয়ে থাকে। দেবী ঘটে স্থাপিতা। মূর্তিও অমিল নয়।
অগ্রহায়ণ মাসে উদযাপিত হয় ‘কুলুই মঙ্গলবার’। অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের মঙ্গলবার পশ্চিমঙ্গের গ্রামগুলিতে তো বটেই, ঝাড়খন্ড, বিহারের গ্রাম অঞ্চলেও মহিলারা কলুই মঙ্গলবার পালন করেন। অনেক জায়গায় আবার চার মঙ্গলবারই পুজো করা হয়।
বাড়ির উঠোনের মাঝখানটিতে আলপনা দিয়ে পোঁতা হয় কুল গাছের ডাল। তারপর ঘট বসিয়ে জোড়া কলা, জোড়া কুল, চিঁড়ে, পাটালি, ধান-দূর্বার অর্ঘ্য দিয়ে পুজো করা হয়। পাঁচজন এয়ো লাগে এই পুজোয়। ‘আকুলিবিকুলি’র ব্রতকথা পাঠ করেন মহিলারা।
আকুলি-বিকুলির ব্রতকথা কী?
এক গ্রামে এক ব্রাহ্মণ থাকত। তার এক ছেলে আর এক মেয়ে। ব্রাহ্মণের বাড়িতে মঙ্গলচণ্ডীর নিত্য পুজো হত। তার মেয়ে প্রতিদিন নিজে হাতে ফুল তুলে, চন্দন বেটে পুজো করত দেবীর। মঙ্গলচণ্ডীতে তার খুব ভক্তি।
একদিন ঠাকুরঘরের পাট করতে গিয়ে সে দেখল ঠাকুরের নৈবেদ্যর জন্য রাখা ফলের মধ্যে একটা জোড়া কলা আছে। সে ভাবল, “জোড়া কলা তো ঠাকুরকে দেওয়া চলে না, তাই আমিই খেয়ে ফেলি…”
এই ভেবে যমজ কলাটি সে খেয়ে ফেলল…
কিছুদিন পর তার ভয়ানক অরুচি হল খাওয়ায়। গাঁয়ের মহিলারা দেখে বলল, “সব্বনাশ হয়েছে! মেয়ে যে পোয়াতি!”
লোকলজ্জার ভয়ে বাবা-মা মেয়ে বনবাসে দিলেন। মেয়েটি একাই থাকে বলে। ফল কুড়িয়ে খায়। দেখতে দেখতে দশমাস দশদিন কেটে গেল। চাঁদের মতো টুকটুকে যমজ ছেলে হল তার।
সদ্য মা হওয়া মেয়ে, নবজাতক দুই সন্তান, কে দেখবে তাদের? বনের মধ্যে পশু-শ্বাপদের ভয়! বুড়ি ব্রাহ্মণীর বেশ ধরে মা মঙ্গলচণ্ডী নিজে এলেন সেই মেয়ের কাছে। বনের মধ্যে পাতার ঘর গড়ে তাকে রাখলেন সেখানে।
ছেলে দুটি বেড়ে উঠতে লাগল। বনে, জঙ্গলে, নদীর ধারে খেলে বেড়ায়। তারা জানত তাদের ‘দিদা’ আছে। বনের মাঝে চণ্ডী ঠাকুরের থান। কাঠুরিয়ারা পুজো দিয়ে যেত সেখানে। নদী পার করার সময় মানুষজন রেখে যেত ফলমূল নানা উপাচার। সেই ফলমূল খেয়ে দিন কেটে যেত দুই ভাইয়ের।
একদিন এক সওদাগর যাচ্ছিল নদীপথ দিয়ে। তার সঙ্গে সাত ডিঙি ধন। তাই দেখে ছেলেরা জিজ্ঞাসা করল “কী আছে নৌকায়? আমাদের বড় খিদে পেয়েছে, দুটি দাও না!”
সওদাগর বলল, “নৌকায় কিছুই নেই, ঘাস-লতাপাতা আছে শুধু…”
ছেলেরা বলল, “তাই হোক”। হাসতে হাসতে বনের মধ্যে চলে গেল তারা।
ডিঙিতে ফিরে গিয়ে সওদাগর দেখে সত্যি সত্যিই সব ডিঙি ঘাস-লতাপাতায় ভরে গিয়েছে। হায় হায় করে উঠল সে! তখন ফের ঘাটে ফিরে, আতিপুতি খুঁজে বের করল যমজ ভাইকে। হাতে-পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বাবা, আমার সর্বনাশ হয়েছে, অর্ধেক ধন তোমাদের দেব, আমার সব যেমন ছিল, তেমন করে দাও…”
ছেলেরা বলল, “আমরা কারুর ভাল বা মন্দ কতে জানিনা, তবে আমাদের দিদিমার লোকের ভাল করতে জানেন।” এই বলে তাকে বৃদ্ধারূপী দেবী মঙ্গলচণ্ডীর কাছে নিয়ে গেল। দেবী সওদাগরকে বললেন, “তুই আমার ব্রতদাসদের অপমান করেছিস, তাই এই অবস্থা। ঘরে গিয়ে কুলুই-চণ্ডীর পুজো কর”
দেবীর আদেশ শিরোধার্য করে ফিরে গেল সওদাগর। নৌকায় গিয়ে দেখে, তার নৌকা আগে যেমন ছিল ঠিক তেমন হয়ে গিয়েছে। দেশে ফিরে কুলুই-চণ্ডীর পুজো করল সে। মন্দির গড়ল।
বনবাসী দুই যমজ ভাইয়ের নাম ছিল আকুলি আর আকুলি। দেবী মঙ্গলচণ্ডী একদিন দুই ভাই আর তাদের মাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন সেই ব্রাহ্মণের বাড়ি। গিয়ে বললেন, “ তোর মেয়ে সতীসাধ্বী। মঙ্গলবার জোড়া কলা খেয়েছিল বলে এই আকুলি-বিকুলি দুই ছেলে হয়েছে। এরা আমার ব্রত দাস। যারাই এদের অপমান করবে, তার বিপদ হবে…” এই বলে দেবী অন্তর্ধান করলেন।
দেশের রাজা স্বপ্নাদেশ পেলেন দেবীর, “অমুক ব্রাহ্মনের মেয়ের সঙ্গে তোর ছেলের বিয়ে দিবি। যদি অন্যথা হয়, তোর দুর্বিপাক অনিবার্য…” রাজা ভয়ে ভয়ে ব্রাহ্মণের মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিলেন।
ব্রাহ্মণের দারিদ্র্য ঘুচল। আকুলি-বিকুলিকে মানুষজন দেবতার মতো ভক্তি করতে লাগল। সেই থেকে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল দেবীর মাহাত্ম্য। অগ্রহায়ণ মাসে প্রতি মঙ্গলবার কুলুইচণ্ডীর পুজো করলে কুলে কলঙ্ক থাকে না-এই বিশ্বাস মানুষের। কুলের মঙ্গল কামনায় এই ব্রত পালন করে থাকেন মহিলারা।