সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই আজকাল চোখে পড়ছে ‘AI’। পেইন্টিং থেকে শুরু করে কনটেন্ট সব দিকেই তার বিস্তার। ‘AI’ মানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, বাংলা করলে হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। প্রযুক্তির দুনিয়ায় দ্রুত গতিতে জায়গা করে নিয়েছে যাবতীয় আলোচনায়। তার মধ্যেই সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ে তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত(এআই) চ্যাটবট—চ্যাটজিপিটি। ২০২২-এর নভেম্বরে চালু হয় চ্যাটজিপিটি। জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ঝড়ের গতিতে। আপনি যা জানতে চাইবেন সব পাবেন। এ যেন এক আশ্চর্য দুনিয়া। অনেকে বলতেই পারেন- সে তো যে কোন সার্চ ইঞ্জিনই জানার খোঁজে উত্তরের খনি। তাহলে চ্যাটজিপিটি আলাদা কেন?
যখন সার্চ ইঞ্জিনে টাইপ করে কোনও কিছু খোঁজা হয় তখন উত্তর হিসেবে মূল টেক্সটের সঙ্গে আসে সম্ভাব্য সমস্ত লিঙ্ক। চ্যাটজিপিটি’তে কিন্তু তেমনটা হয় না। এখানে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্রশ্নের যে উত্তর আসে, অনেক স্পষ্ট এবং সম্ভাব্য সমস্ত তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ।
চ্যাটজিপিটি কী?
চ্যাটজিপিটির পুরো নাম চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফর্মার। চ্যাটজিপিটি হল একটি মেশিন লার্নিং মডেল। চ্যাটজিপিটিকে যে কোনও প্রশ্ন করলে লিখিত আকারে মানুষের মতো উত্তর দিতে পারে। ঠিক যেভাবে আপনি মেসেঞ্জারে টেক্সট মেসেজের উত্তর আসে করে একেবারেই সেভাবেই। ইংরেজি থেকে শুরু করে যে কোনও ভাষায় প্রশ্ন করলে সেই ভাষাতেই জবাব আসে। উত্তর দেখে বোঝার উপায় থাকে না যে উত্তরদাতা আর্টিফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল।
চ্যাটজিপিটির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত (এআই) প্রযুক্তি নিজেদের বিং সার্চ ইঞ্জিন ও এজ ব্রাউজারে যুক্ত করেছে মাইক্রোসফট। মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি জানিয়েছেন চ্যাটজিপিটি ইন্টারনেট আবিষ্কারের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। চ্যাটজিপিটি পুরো বিশ্বকে বদলে দেবে।
চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা করেছে। ২০১৫ সালে ইলন মাস্ক ও স্যাম অল্টম্যান শুরু করেছিলেন এই চ্যাটবট তৈরি করার কাজ। ওপেনআইয়ের দুনিয়ায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন চ্যাটজিপিটি। যদিও ইলন মাস্ক ২০১৮ সালে বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেন।
ওয়েবসাইটটি চালু হওয়ার ৫ দিনের মধ্যে ১ মিলিয়ন ছাড়িয়েছিল ব্যবহারকারীর সংখ্যা। চ্যাটজিপিটি ওয়েবসাইটে যেমন ব্যবহার করা যায়, সেভাবে অ্যাপও ব্যবহার করা যায়। ওয়েবসাইটে ব্যবহার করতে হলে প্রথমেই অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে হবে। সেখানে একটি একাউন্ট খুলতে হবে আপনাকে। ওয়েবসাইটের হোম পেজ খোলার পর আপনি ‘লগইন’ ও ‘সাইন আপ’ দুটি অপশন দেখতে পাবেন। আপনাকে সাইনআপ অপশনে ক্লিক করতে হবে। ইমেল আইডি বা ফোন নাম্বার দিলে একটি ভেরিফিকেশন ওটিপি আসে। ফোন নম্বর যাচাই করার পরে চ্যাটজিপিটিতে আপনার অ্যাকাউন্ট তৈরি হয়ে যাবে। এবার চ্যাটজিপিটির উইন্ডোতে প্রবেশের পর আপনি যা জানতে চান, তা চ্যাটবক্সে লিখে ফেলুন। তবে আপনাই যা সার্চ করুননা কেন সেটা আপনাকে বাক্যের আকারে লিখতে হবে শুধুমাত্র যে বিষয়টি জানতে চাইছেন তার নাম দিয়ে সার্চ করলে এক্ষেত্রে হবে না।
চ্যাটজিপিটির রয়েছে আকর্ষণীয় কিছু ফিচার। রচনা লেখা থেকে শুরু করে গানের লিরিক্স লেখা, গল্প লেখা, এমনকি কবিতা লিখতেও নির্দেশ দেওয়া যাবে এই চ্যাটবটকে। জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা, অনুবাদ, কোডিং, কোড ডিবাগিং, স্পিচ অ্যান্ড টেক্সট অ্যানালেসিস করা যায়।
তবে চ্যাটজিপিটির বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। সব সময় যে সঠিক উত্তর আসে এমন নয়। সব প্রশ্নের উত্তর দিতেও পারে না। ধরুন আপনি কোনও ব্যক্তিত্ব কিংবা নিজের নাম লিখে সার্চ দিয়ে নিজের সম্পর্কে জানতে চাইলেন। চ্যাটজিপিটি অনেকক্ষেত্রে তার এমন তথ্যবহুল জবাব দিয়েছে যে প্রশ্নকর্তা নিজের সম্পর্কে চমকে গিয়েছেন। চ্যাটজিপিটি শুধুমাত্র টেক্সট নির্ভর। অডিয়ো, ইমেজ, ভিডিয়োর সুবিধা এখনও পর্যন্ত এই মাধ্যমে পাওয়া যায় না।
এখন পর্যন্ত চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতে কোন টাকা লাগে না। তবে ওপেনআই অ্যাপ-এর পেইড ভার্সান আছে। যেখানে ৩ সপ্তাহের ট্রায়াল ভার্সানের পর এক বছরের পেইড ভার্সন করা যায়।
চ্যাটজিপিটি নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে ইতালিতে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ চ্যাটজিপিটি। সরকারীভাবে জানানো হয়েছে, ডিজিটাল দুনিয়ায় তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার উদ্দেশ্যে চ্যাটজিপিটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইতালির এই সিদ্ধান্তের পর ইউরোপের অন্যান্য দেশও চ্যাটজিপিটিকে নিষিদ্ধ বা কঠোর বিধিনিষেধ দেওয়া যায় কি না, এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। জার্মানিতে চ্যাটজিপিটির ব্যবহার নিষিদ্ধ হতে পারে বলে জানিয়েছে দেশটির তথ্য সুরক্ষা কমিশনার। ফ্রান্স ও আয়ারল্যান্ডের নিয়ন্ত্রক সংস্থাও চ্যাটজিপিটির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার বিস্তারিত তথ্য জানতে ইতালির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
একই কারণে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাও তথ্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিষয়ে ওপেনএআইয়ের কাছে জানতে চেয়েছে। এ বিষয়ে ওপেনএআই জানিয়েছে, চ্যাটজিপিটির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রশিক্ষণে ব্যক্তিগত তথ্যের ব্যবহার কমানোর জন্য কাজ চলছে।
আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স কতটা সুরক্ষিত? এই প্রশ্ন তুলেছেন ইলন মাস্ক স্বয়ং। ‘ওপেন এআই’ জিপিটি-৪ বাজারে আনার পরই একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। চিঠিতে গণ স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়েছে। ১ হাজার জনেরও বেশি স্বাক্ষর করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন টেসলা কর্তা ইলন মাস্ক, অ্যাপেলের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্টিভ ওজ়নিয়াক সহ একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাঁরা চিঠিতে লিখেছেন, “মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এমন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবস্থা সমাজ ও মানবজাতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। শক্তিশালী এআই ব্যবস্থা তখনই তৈরি করা উচিত, যখন এর ইতিবাচক প্রভাব ও এর ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে আমরা আত্মবিশ্বাসী হব।”
আরও একটি বিষয়ের কারণে প্রশ্ন উঠছে চ্যাটজিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। মানুষের পেশার পরিসর কমাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংকিং সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাকসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৩০ কোটি কর্মী চাকরি হারাতে পারেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে।
সারা বিশ্বেই এই মুহুর্তে গবেষক, সাধারণ শিক্ষার্থী এবং ব্যবসায়িক নানা পেশার মানুষজন চ্যাটজিপিটির সহায়তা নিতে শুরু করেছেন। তবে এখনও এই ব্যবহার অ্যামেচার পর্যায়ে আছে।
চ্যাটবট চ্যাটজিপিটির বিকল্প হিসেবে সম্প্রতি আগে বার্ড (বিএআরডি) নামের নিজস্ব চ্যাটবট উন্মুক্ত করেছে গুগল। তবে তা সেভাবে জনপ্রিয়তা না পাওয়ায় ভবিষ্যতে চ্যাটবটটিতে পিএএলএম ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল ব্যবহার করা হবে বলে জানিয়েছেন সুন্দর পিচাই। ফলে কোডিং বা গাণিতিক বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর ভালোভাবে দিতে পারবে চ্যাটবটটি।
চ্যাটজিপিটির ব্যবহার এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে স্পষ্টতই দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে পৃথিবী। ভাল আর খারাপ দুই দিকই উঠে আসছে আলোচনায়। চ্যাটজিপিটি ভুল করে, আবার ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের তথ্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধও করে। কোনও প্রশ্নের উত্তর যদি সে ভুল দেয় তাহলে পুনরায় নিযুক্ত থাকা কর্মীরা প্রশ্নের সঠিক উত্তরটি সিস্টেমে ইনপুট করে দেয়।
ওপেনএআই চ্যাটবট ইন্টারনেটে উপলব্ধ টেক্সট ডাটাবেস থেকে তথ্য গ্রহণ করে কাজ করে। ইন্টারনেটে থাকা ওয়েব পেজ, ওয়েব টেক্সট, বই, উইকিপিডিয়া, আর্টিকেল সহ বিভিন্ন সোর্স থেকে প্রায় ৫৭০ জিবির বেশি ডাটা সমৃদ্ধ এই চ্যাট জিপিটি। শুধু তাই নয় এই চ্যাট বটে রয়েছে ৩০০ বিলিয়ন শব্দের ভাণ্ডার।
এত কিছুর মধ্যেও উঠে আসছে একটি ভিন্ন মত। সেই মত বলছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের বুদ্ধিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারছে কিন্তু মানুষের হৃদয়টিকে সে ছুঁতে পারবে না। চ্যাটজিপিটি আপনার সঙ্গে পাশে বসা বন্ধুর ভাষায় কথা বলে যাবে। কিন্তু যে মুহূর্তে আপনি তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, ‘তোমার কি মন খারাপ?’। সেই প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারে না। তার মগজ আছে, কিন্তু আবেগ নেই।
তবে গবেষকদের মত, আপাতত মগজের ওপরে হৃদয়ের দাবিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে মানুষ হারিয়ে দিলেও সে যেভাবে নিজেকে অগ্রসর করছে তাতে হৃদয়, আবেগকেও যে ছুঁয়ে ফেলবে তেমন দিন দূরে নয়।