বৈশাখ মাস। চৈত্র থেকে যে দাবদাহের জন্ম, বৈশাখে সে যেন যৌবন পেয়ে যায়। এবং, যৌবনের উন্মাদনায় দাপিয়ে বেড়ায়। তার দাপটে জীবকুল যখন ‘ত্রাহি ত্রাহি’ রবে মুমূর্ষু হয়ে ওঠে; তখন ধর্মপ্রাণ মানুষ তাদের সহায় হন, তাদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। বৈশাখের দাবদাহে সেই সব ধর্মপ্রাণ মানুষের সেবাদৃষ্টি থেকে উদ্ভিদ-বৃক্ষও বাদ যায় না। তার অবশ্য ধর্মীয় পেক্ষাপট আছে, পৌরাণিক অনুজ্ঞাও আছে।
পাড়া গাঁ’র বয়স্কা মহিলারা সারা বৈশাখ মাস জুড়ে প্রতিদিন নদী বা পুকুরে স্নানের পর ভিজে কাপড়ে আগে অশ্বত্থ গাছের তলায় শালপাতায় খানিকটা আখের গুড় ও ভেজা ছোলা নৈবেদ্য দেন। গাছের গোড়ায় জল দেন। প্রণাম করেন। তারপর গৃহে প্রবেশ করেন। এ তাঁদের এই সময়ের নিত্যকর্ম। অশ্বত্থ তাঁদের কারও কাছে জীবনবৃক্ষ। তাই বৈশাখের দাবদাহে নিজের ও পরিবারকে সুরক্ষিত রাখার জন্য তাঁকে জল-নৈবেদ্যে তুষ্ট করেন তাঁরা। আবার অনেকের কাছে অশ্বত্থ গাছ হল ‘ব্রাহ্মণ’। সারা বৈশাখের তৃষ্ণাতুর মধ্যাহ্নে জল, গুড় ও ছোলা অশ্বত্থে অর্পণ করে তাঁরা ব্রাহ্মণ-সেবার পুণ্য অর্জন করেন। অনেকেই আবার এই সময় অশ্বত্থ গাছকে ব্রাহ্মণজ্ঞানে তার গুড়িতে সুতো পেঁচিয়ে পৈতে পরিয়ে দেন। মাটির ভাঁড়ের তলায় ফুটো করে, সেই ভাঁড়ে জলভর্তি করে গাছের ডালে টাঙিয়ে দেন; যাতে সারা দিনমান জল দিয়ে তাঁর চরণ ধুইয়ে দেওয়া যায়। সুতরাং, পুরো ব্যাপারটার মধ্যে সেবাধর্ম রয়েছে, রয়েছে পুণ্যকর্মের সাধনা।
শুধু যে পাড়া-গাঁর বয়স্ক মানুষেরা অশ্বত্থ গাছে জল ও নৈবেদ্য এই সময় দিয়ে থাকেন; বিষয়টা এমন নয়। নগর কলকাতা এবং শহরতলির অসংখ্য এদেশি ও দেহাতী রমণীরাও বৈশাখে এই অশ্বত্থ-সেবা করে থাকেন।
হিন্দু রমণীরা বৈশাখ জুড়ে এই আচার পালন করলেও সংস্কৃতির ঐতিহাসিকেরা বলেন যে, এর উৎস নাকি বৌদ্ধধর্ম। কারণ, বৌদ্ধদের কাছে এই বৈশাখ মাস ও অশ্বত্থ বৃক্ষ অতীব পবিত্র। কেননা, এই গাছের নীচে বসে তপস্যা করে বুদ্ধদেব বৈশাখ মাসেই বোধি বা সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। বুদ্ধের সিদ্ধির স্মরণে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ পুরো মাস জুড়ে অশ্বত্থ ও বুদ্ধের উপাসনা করেন। তাঁদের এই চর্যা ক্রমে হিন্দু সংস্কারের মধ্যে ঢুকে গেছে। কারণ, অশ্বত্থ হিন্দুশাস্ত্রে কথিত পঞ্চবটের অন্যতম।
তবে হিন্দুশাস্ত্রেও বৈশাখ মাস পবিত্র মাস হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। তার কারণ হিসেবে তারিণীপ্রসাদ জ্যোতিষী লিখিত ‘বৈশাখ মাস’ প্রবন্ধে দেখা যাচ্ছে যে, ‘বৈশাখমাসে সূর্য মেষরাশিতে উপস্থিত হয়েন, হিন্দুশাস্ত্র উত্তরায়ণমধ্যে এই মাস সর্বশ্রেষ্ঠ পুণ্যমাস বলিয়া কথিত হয়। যাবতীয় পুণ্যকার্যের অনুষ্ঠান করিবার জন্য এই মাসে ঋষিরা যে ব্যবস্থা করিয়া গিয়াছেন, তাহা ধর্মশীল মানবগণের পক্ষে অবশ্য কর্তব্য। উহা দৈহিক ও মানসিক বিশেষ উন্নতিসাধক। ঋষিগণ বলেন,—বৈশাখমাসে জলদান, অন্নদান, ছায়াদান, ছত্রদান, পাদুকাদান, বটবৃক্ষাদি রোপণ, অতিথি-সৎকার ও জলাশয়াদি খনন পুণ্যজনক।’ অর্থাৎ বৈশাখে নিয়মিত বটে জল না-দেওয়ার নিদান না-থাক; হিন্দুশাস্ত্রে বট-রোপণের বিধান রয়েছে।’ উল্লেখ্য যে, ‘স্কন্দপুরাণ’-এর বিষ্ণু খণ্ডের ‘বৈশাখ মাস মাহাত্ম্য’ অংশে দেবর্ষি নারদের মুখ দিয়ে এই কথাগুলোই বলানো হয়েছে।
হিন্দুশাস্ত্র বৈশাখে অশ্বত্থগাছে জল ঢালার নিদান না-দিলেও হিন্দুবিশ্বাস তুলসী গাছে জল ঢালার নিদান দিয়েছেন। শাস্ত্র বলেছেন যে, বৈশাখ মাস হরির অত্যন্ত প্রিয়। ‘পদ্মপুরাণ’-এ বলা হয়েছে, তুলসী হচ্ছেন কৃষ্ণের প্রেয়সী। যেখানে তুলসী, সেখানেই তিনি বিরাজমান। তাই ‘পদ্মপুরাণ’-এর পাতাল খন্ডে যম বলেছেন যে, যদি কেউ বৈশাখ মাসে ত্রিসন্ধ্যা তুলসী পাতা দিয়ে কৃষ্ণের পুজো করেন, তাহলে তাঁর আর পুনর্জন্ম হয় না। তবে বৈষ্ণবের বিশ্বাস, তুলসী ও শালগ্রামে বৈশাখ মাসে জলের ধারা দিলে ভগবান বিষ্ণু অত্যন্ত তুষ্ট হন। কৃপা করেন। বৈষ্ণব-বিশ্বাস ক্রমে লোকবিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলার ব্রত’ গ্রন্থে সংকলিত বারমাসের পার্বণের বর্ণনা-বিষয়ক যে ছড়াটি রয়েছে, তাতে এই বিশ্বাস-নির্ভর আচারটির উল্লেখ আছে—
‘চৈত্র মাসে চড়ক সন্ন্যাস গাজনে বাঁধে ভারা,
বৈশাখ মাসে তুলসী গাছে দেয় বসুধারা।’
তুলসী গাছে ‘বসুধারা’ ব্যাপারটা কী? কেউ বলেন ‘বসুধারা’, কেউ বলেন ‘বসুন্ধরা’; আবার কেউ বা বলেন ‘বসনঝারা’। মাটির ভাঁড়ের নীচের ফুটোয় দুব্বো ঘাস গুঁজে সেই ভাঁড়ে জল ভরে তুলসী গাছের ওপর টাঙিয়ে দেওয়া হয়। গাছের ওপর তা থেকে অবিরত ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে। ভিজে থাকে তার পাদমূলের মাটি।
বৈষ্ণবমণ্ডলে তুলসীতে এই জলদানকে কেন্দ্র করে মোক্ষলাভের একটি কাহিনি প্রচলিত আছেঃ
বৈশাখ মাসে এক বৈষ্ণব নিত্য তুলসীতে জল দিতেন। একদিন তিনি স্নান করে তুলসীতে জল দিয়ে প্রদক্ষিণ করে ঘরে যেতেই একটি কুকুর দারুণ তৃষ্ণার্ত হয়ে সেখানে এল। তুলসীর গোড়ায় বৈষ্ণব-নিবেদিত জল তখনও কিছুটা ছিল। তাই-ই সে চোঁ চোঁ করে খেয়ে ফেলল।
তারপর বৈষ্ণবের ঘর থেকে বেরুতেই এক ব্যাধের প্রচণ্ড তাড়া খেল সে। কেননা, খানিক আগেই সে ব্যাধের হাঁড়িতে রান্না করা খাবার চুরি করে খেয়েছে। তারপর হাঁড়িটিও ভেঙে এসেছে। ক্ষুধার্ত ব্যাধ শিকার করে ফিরে ভাঙা হাঁড়ি দেখেই মারাত্মক রেগে গেল। কুকুরটির হাঁড়িখাওয়া স্বভাব সে জানত। তাই দারুণ ক্রোধে কুকুরটিকে হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে বৈষ্ণবের ঘরের বাইরে তাকে পেতেই খানিকটা তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে তির ছুঁড়ে মেরে ফেলল।
অমনি যমদূতেরা কুকুরটির আত্মাকে শেষ বিচারের জন্য যমলোকে নিয়ে যেতে সেখানে হাজির হল। কিন্তু তারা নিয়ে যাবার আগেই বিষ্ণুদূতেরা এসে তাদের বাধা দিল। বলল, কুকুরটি অনেক অন্যায় করলেও যেহেতু শেষ সময়ে তুলসীপাদমূলের জল খেয়েছে, তাই তার সমস্ত পাপ বিনষ্ট হয়ে গেছে। এখন সে বিষ্ণুলোকে অনন্তকাল বাসের যোগ্য হয়ে উঠেছে।–এই বলে তারা কুকুরকে সোনার রথে চড়িয়ে বিষ্ণুলোকে নিয়ে চলে গেল।
কাহিনির বক্তব্য একটাইঃ বৈশাখে তুলসীপাদমূলের জল খেয়ে যদি বিষ্ণুলোকে যাবার পুণ্য অর্জিত হয়, তাহলে তুলসীতে জল ঢেলে কতই না পুণ্য হয়—এটা বোঝানো! বহু বছরের ঐতিহ্য ধরে এখনও এই কাহিনির নির্যাসটুকু মাথায় নিয়েই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অসংখ্য বিষ্ণুভক্ত ও পুণ্যার্থী মানুষ পুরো বৈশাখ মাস জুড়ে স্নানের পর তুলসী প্রদক্ষিণ করে তুলসীতে জল ঢেলে তারপর গৃহে ঢোকেন। তুলসীতে জল দেওয়ার সময় মন্ত্র পড়েনঃ
‘গোবিন্দবল্লভাং দেবীং ভক্তচৈতন্যকারিনীম।
স্নাপয়ামি জগদ্বাত্রীং কৃষ্ণভক্তিপ্রদায়িনী।।’
যাই হোক, তুলসীতে জলদানের এই রীতি ধর্মপথের মানুষের কাছে সনাতনীধারায় পুণ্যলাভের জন্য সেবা; আর সংস্কৃতির গবেষকের কাছে খরতাপে জলের অভাব থেকে বীরুৎজাতীয় গাছ বাঁচানোর কৌম-কৌশল। উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, এই আচার আমাদের আবহমান বঙ্গসংস্কৃতির অঙ্গ; প্রজন্মের পথ বেয়ে ধারা খানিকটা ক্ষুন্ন হলেও এগিয়ে চলেছে বংশপরম্পরায়…