মহাপ্রলয়ের আগে ন্যূহকে স্বপ্নাদেশে ভগবান বিষ্ণু কী নির্দেশ দিয়েছিলেন?

সত্য , ত্রেতা ও দ্বাপরের পরে কলি যুগের শুরু। কৃষ্ণ ও বলরামের দেহত্যাগের কথা শুনে পান্ডবরা দ্রৌপদী সহ মহাপ্রস্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এরপর পান্ডবদের বংশধরা আর্যদেশে শাসন করতে থাকেন। ভবিষ্য পুরাণ অনুযায়ী হস্তিনাপুরে পান্ডবদের বংশধর ক্ষেমকের প্রপৌত্র সুনন্দ ছিলেন আর্যদের শেষ রাজা। এরপর কলিযুগের সূচনা হয়, মানুষ বেদ ভুলে যায় ও অনাচারী হয়ে ওঠেন। কীভাবে কলি যুগের সূচনা হয় ও পরবর্তীতে ভগবানের রোষানলে মহাপ্রলয় সৃষ্টি হয় তাই আজকে বলব।

ধার্মিক রাজা ক্ষেমকের পর তার পুত্র প্রদ্যোত সিংহাসনে বসেন। প্রদ্যোতের রাজত্বেও কেউ অধার্মিক আচরণ করতে পারতেন না। তিনি দশ সহস্র বছর রাজত্ব করেছিলেন। এরপর প্রদ্যোত রাজার ছেলে বেদবান দুই সহস্র বছর রাজত্ব করেন। পান্ডবদের মতই ধর্মপরায়ণ ছিলেন ক্ষেমক, প্রদ্যোত ও বেদবান। যে কারণে এদের সময়কালে কলি যুগ নিজের প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। বেদবানের রাজত্বে কলি নিজের প্রভাব বিস্তার করতে না পারায় দুঃখিত মনে সে ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলো ও ভগবান বিষ্ণুর স্তুতি করে বলল, বেদবানের রাজত্বে আমি নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না আপনি আমাকে সাহায্য করুন, আমার সহায় হোন। 

মানুষকে অনাচারী করবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কলি আকুল প্রার্থনা শুরু করলে ভগবান শ্রী হরি আবির্ভূত হলেন এবং তাকে বললেন, তুমি ভেবো না কলি, ধৈর্য্য ধরো, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে, তুমি আমার শরণ নিয়েছ, সব দায়িত্ব আমার। কলিযুগের সূচনা হলেই যুগ ধর্ম অনুসারে মানুষ অনাচারী হয়ে উঠবে এই বিধির বিধান। ভগবান নারায়ণের থেকে এই আশ্বাস বাক্য পেয়ে কলি মহানন্দে নীলাচল পাহাড়ে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল। 

বেদবানের পর তার পুত্র সুনন্দ রাজ্যভার হাতে তুলে নেন। বেদবানের পুত্র সুনন্দও তার পূর্বসূরীদের মতো অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ছিলেন আর তিনিও তার রাজত্বকালে আর্যদেশকে অনাচার মুক্ত করতে সবসময় সচেষ্ট থাকতেন। কিন্তু তার কোনও সন্তান ছিলো না, যে কারণে এই ধর্ম পরায়ণ রাজার রাজত্ব শেষ হয়ে গেলো। আর্যদের শেষ রাজা ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর পরেই কলি তার প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে ও এক প্রবল অমঙ্গলের আশঙ্কা করে ঋষি ও মুনিগণ তখন নৈমিষারণ্য ত্যাগ করে হিমালয় চলে গেলেন ও সেখানে থেকে তারা ভগবান বিষ্ণুকে ডাকতে থাকলেন, যাতে কলির অবসান হয়।

সেই সময় আর্যদেশের মহাবনে আদম ও হব্যবতী নামের অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ স্বামী-স্ত্রী বাস করতেন, তারা ছিলেন নির্লোভ ও ধার্মিক। গাছের ফলমূল খেয়েই তারা জীবন ধারণ করতেন। কিন্তু সেই বনে একটি পাপ গাছ ছিল, যে গাছের ফল মিষ্টি হলেও সেই ফল যে খাবে কলি তাকে গ্রাস করবে অর্থাৎ কলির প্রভাবে পড়ে সেও ন্যায় ধর্ম ভুলে যাবে। কলিকে ভগবান নারায়ণ নির্দেশ দেন আদম ও হব্যবতীকে প্রলুব্ধ না করার জন্য। কিন্তু কলি ভগবান বিষ্ণুর আদেশ অমান্য করে সেইবনে প্রবেশ করে। কলির প্রবেশের ফলে বনের অন্যান্য গাছগুলো ভেঙে সাপের আকৃতির হয়ে যায় এতে আদম হব্যবতীর মতিভ্রম ঘটে ও তারা পাপ গাছের ফল খেয়ে। এই ফল খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মন হিংসায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং তারা অনাচারী হয়ে ওঠেন। আদম- হব্যবতীর পরবর্তী বংশধররাও বৈদিক ধর্ম ভুলে অনাচারে লিপ্ত হন। এই সময় আর্যাবর্ত টুকরা টুকরো হয়ে যায় ও কলির রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।


কলির প্রভাবে এইসময় মানুষ বেদকে অগ্রাহ্য করতে শুরু করে, এভাবেই বেশ কয়েক বছর কেটে যায়। এরপর আদমের বংশের লোমকের ছেলে ন্যূহ রাজা হয়। ন্যূহ আদমের বংশের লোক হলেও বেদ না পড়লেও সে ভগবান বিষ্ণুর ভক্ত ছিল। তার মনে ভগবানের প্রতি এক আস্থা ছিল। তাই ভগবান নারায়ণ ন্যূহকে একদিন স্বপ্ন দিয়ে বলেন, বৎস ন্যূহ, আজ থেকে সাত দিন পরে মহাপ্রলয় হবে, তাতে কেউ বাঁচবে না, তুমি আমার ভক্ত তোমাকে রক্ষা করার জন্য বলছি, তোমার আত্মীয় পরিজন নিয়ে তুমি একটি নৌকায় উঠে জীবন রক্ষা করো আর সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পর তুমি হবে এই পৃথিবীর নতুন রাজা।ভগবানের কথা অনুযায়ী ন্যূহ সকল আত্মীয়-স্বজনকে এক জায়গায় জড়ো করলেন এবং একটি নৌকোতে সব ধরনের শস্য ভরে নিলেন। তার এই কাজকর্ম দেখে সকলে ভাবলো রাজা পাগল হয়ে গিয়েছেন।

কেউ এই অদ্ভুত কাজের পিছনে কারণ জিজ্ঞেস করলে ন্যূহ বললেন সময় হলেই বুঝতে পারবে। ৩০০ হাত লম্বা, ৫০ হাত চওড়া ও ত্রিশ হাত উঁচু বিশালাকার এক নৌকা দেখে সকলে অবাক হয়ে গেল। এরপর সঠিক সময় অর্থাৎ সাত দিনের মাথায় ন্যূহ সকলকে নিয়ে নৌকায় উঠে পড়ল। যখন প্রলয় হল তখন সব কিছু জলের তলায় চলে গেল একমাত্র ন্যূহের নৌকা ভাসতে থাকলো। একটানা ৪০ দিন পর সেই বৃষ্টি কমল।


অন্যদিকে সুনন্দের মৃত্যুর পর নৈমিষারণ্যের থেকে হিমালয়ের বিশালাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন মুনিরা, সেখানেই তারা জপ ধ্যান করতেন, ন্যূহের নৌকা সেখানেই গিয়ে থামলো। ন্যূহ নৌকাতে বসে রইলেন এরপর মুনিদের প্রার্থনায় মহামায়া তুষ্ট হলেন ও বর্ষা থেমে গেল, আকাশ পরিষ্কার হল, সূর্যের প্রকাশ হলো ও জল স্তর নেমে গেলো। শিষিনা নামে হিমালয়ের একটি স্থান তখন ন্যূহের চোখে এল। তখন সকলকে নিয়ে নৌকা থেকে ন্যূহ নামলেন এবং গড়ে তুললেন নতুন দেশ।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...