শিবলিঙ্গের পূজা করবার পর ভগবান বিষ্ণুর সঙ্গে কী ঘটেছিল?

শিব পুরাণে শিব তত্ত্ব বর্ণিত আছে। বিষ্ণুপুরাণে যেখানে দেবাদিদেব মহাদেবকে পরম বৈষ্ণব, ভগবান বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত রূপে বর্ণিত করা হয়েছে, সেখানে শিব পুরাণে শিব‌ই সর্বেসর্বা, তিনি আদি,তিনি অন্ত, আবার তিনি ভাগ্যবিধাতা। শিবপুরাণ অনুযায়ী, শিবের মাহাত্ম্যকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছে, তাই বিষ্ণু তত্ত্ব সেখানে গৌণ। শিবপুরাণে বর্ণিত আছে, নারায়ণের নাভিমূল থেকে অনন্ত যোজন ব্যাপ্ত একটি পদ্ম সৃষ্টি হয় এবং সেই পদ্ম থেকে জন্ম নেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। জন্মগ্রহণ করার পর তার মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসা সৃষ্টি হয় তিনি কে এবং তার স্বরূপ কী? পদ্মের নাল ধরে বহু বছর ওঠানামা করেও যখন তিনি মূল খুঁজে পেলেন না তখন তিনি দৈববাণীতে শুনলেন তপস্যা করবার কথা।

এরপর বহু বছর তপস্যা করবার পর তিনি বিষ্ণুর দেখা পেলেন, ব্রহ্মা তখন বিষ্ণুকে জিজ্ঞাসা করলেন তার পরিচয়। বিষ্ণু নিজেকে ব্রহ্মার সৃষ্টিকর্তা বলে দাবি করলে ব্রহ্মা বিষ্ণুর মায়ায়  মোহিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? তোমার ও নিশ্চয়ই কর্তা আছেন। এই সময় দুজনের মধ্যে ঝগড়া সৃষ্টি হল ও দুজনেই যুদ্ধরত হলেন, এমন সময় তাদের দুজনের মাঝখানে জ্বালাময় আদি-অন্তহীন এক বিশাল জ্যোতির্লিঙ্গের আবির্ভাব হল। ব্রহ্মা ও বিষ্ণু কেউই সেই লিঙ্গের আদি-অন্ত খুঁজে পেলেন না। তখন তারা সেই শিবলিঙ্গকে বারবার নমস্কার করলেন।

এরপর তাদের সামনে পঞ্চমুখ দশ বাহু উজ্জ্বল গৌরসুন্দর এক মূর্তি আবির্ভূত হলেন তখন ব্রহ্মা ও বিষ্ণু বুঝতে পারলেন তিনি মহেশ্বর মহাদেব। দেবাদিদেব মহাদেবই এরপর ভগবান বিষ্ণু ও ব্রহ্মাদেবকে জগৎ পালন ও সৃষ্টির কাজ অর্পণ করেছিলেন, ও দেবাদিদেব মহাদেব নিজে হয়েছিলেন অনুগ্রহকারী ও সংহারকর্তা। অতঃপর দেবাদিদেবের আদেশেই ব্রহ্মা ও বিষ্ণু সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হয়ে ওঠেন। এই ভাবেই শিবপুরাণে শিবকে জগতের সমস্ত কিছুর মূল রূপে বর্ণিত করা হয়েছে। শিব পুরাণ অনুযায়ী শিব  ভগবান, আর ব্রহ্মা ও বিষ্ণু তাঁর পুজো করে ফল লাভ করেছেন।

শিব পুরাণে এক জায়গায় ভগবান বিষ্ণুর ও ব্রহ্মা দেবের লিঙ্গ পুজোর ফললাভের কথা বর্ণিত আছে। শিব পুরাণের ধর্ম সংহিতার একাদশ অধ্যায়ে বিষ্ণুর লিঙ্গ পূজার ফললাভের কথা উল্লেখিত রয়েছে। সেই অধ্যায়ে লেখা আছে, উগ্রশ্রবার পুত্র সূত শৌণকাদি ঋষিদেরকে বললেন ভগবান বিষ্ণু মহাদেবের লিঙ্গ দেখে ভক্তিপূত চিত্তে শিবের স্তব করতে লাগলেন। তিনি বললেন, অপরিমিত জ্যোতিবিশিষ্ট স্থানু, শান্তগুণ অবলম্বী ও মঙ্গলপ্রদ শিবকে আমি বারবার নমস্কার করি।

যে দেব প্রলয়কালে রুদ্র মূর্তি ধারণ করে বিশ্বসংহার করেন, যিনি সকল দেবগনের প্রধান, যার হস্তে সর্বদা শূল বিরাজিত সেই শম্ভুকে আমি বারবার নমস্কার করি। যিনি তপোময়, যাঁর ত্রিনয়ন, যিনি মস্তকে গঙ্গা প্রবাহ ধারণ করে আছেন, যিনি গৌরীর প্রিয়, সেই হরকে আমি বারংবার নমস্কার করি। যিনি কামদেবের পরম শত্রু, যিনি ত্রিপুরাসুর নিহন্তা, যিনি দেব মধ্যে অতি সুন্দর, যার বর্ণ অতি শুভ্র, তাকে আমি নমস্কার করি। এইভাবে বিষ্ণুর দ্বারা বারংবার স্তুত হয়ে শিবলিঙ্গ বললেন, হে বিধাতা, হে বিষ্ণু তুমি আমার স্তব করলে আমি তোমার স্তবে প্রীত হয়েছি। তোমার মনের অভিলাষ পূরণ হোক এবং তুমি অভিলষিত বস্তু প্রাপ্ত হও।

এইভাবে ভগবান বিষ্ণু শিবলিঙ্গ স্তুতি করবার ফলে তিনি শিবলিঙ্গের আশীর্বাদে সংগ্রামে দূর্জয়ত্ব লাভ করলেন এবং মনুষ্যলোকে উত্তম পূজা ও প্রজাবর্গের পালন শক্তি প্রাপ্ত হলেন।

এরপর ব্রহ্মা ও শিবলিঙ্গের ভক্তিভরে স্তুতি করলেন এবং শিবলিঙ্গের পূজা আরম্ভ করলেন। তার ফলস্বরূপ শিবলিঙ্গের প্রসাদে ব্রহ্মা যতকাল মন্বন্তরসমূহ না হয় ততকাল পর্যন্ত নিজের সৃষ্টির অক্ষয়ত্ব প্রাপ্ত হলেন। ব্রহ্মা বিষ্ণুর পর অন্যান্য দেব গণ‌ও ভক্তিভরে শিবলিঙ্গ পুজো করলেন এরপর স্বর্গ‌ ও মর্ত্য লোকে শিবলিঙ্গ পূজার প্রচলন হল।

শিব পুরাণে আরও বর্ণিত আছে যে, যে সকল ব্যক্তি পবিত্র দেহে ও মনে ভক্তিপূর্বক শিব লিঙ্গের স্তব করবে তারা ইহকালের সকল অভিলাষ প্রাপ্ত হবে এবং পরকালে সদগতি লাভ করবে। এছাড়া শিবলিঙ্গ পূজার ফলে অর্থ ও পরমার্থ দুই লাভ হয় এবং স্বর্গলাভ পর্যন্ত হয়। শিবলিঙ্গ পূজা করলে মানুষের  সমস্ত কামনা পূর্ণ হয়, সুখেচ্ছু ব্যক্তিগণের সুখলাভ হয় আর রাজগণের রাজ্য প্রাপ্তি হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...