হিন্দু ধর্মে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ত্রিদেবের কথা বলা হয়েছে। তাঁরা সৃষ্টি, স্থিতি এবং ধ্বংসের প্রতীক। এই তিন দেবতার আধারেই গড়ে ভারতের যত প্রাচীন পুরাণ, লোকগাথা, কাহিনি । যুগে যুগে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্য বারবার জন্ম নিয়েছেন ভগবান বিষ্ণু। হিন্দু ধর্মের অষ্টাদশ পুরাণের অন্যতম গরুড় পুরাণে শ্রী বিষ্ণুর দশাবতারের কথা বর্ণিত আছে। দশাবতার স্তোত্র অনুযায়ী তিনি বেদের উদ্ধারকারী। ত্রিলোকের ভার বহন করেন। অশুভকে নাশ করে ধরনীকে রক্ষা করেন।
বিষ্ণুর অবতার নিয়ে সংশয় আছে। কোথাও কোথাও তাঁর ২২ অবতারের কথাও বলা আছে। ভাগবত পুরাণে আছে ২৪ অবতারের কথা। তবে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, কল্কি- এই দশাবতারই সর্বাধিক প্রচলিত।দক্ষিণ ভারতে বলরামও দশাবতারের অন্তর্ভূক্ত। দশাবতারের অন্যতম অবতার হিসেবে গৌতম বুদ্ধের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে অবশ্য নানা মত পাওয়া যায়। কলিযুগে বিষ্ণুর নবম অবতার হিসেবে অবতীর্ণ। মহারাষ্ট্র ও গোয়ার ঐতিহ্য অনুসারে পঞ্চাঙ্গ ও বিভিন্ন মন্দির স্থাপত্যে বিঠোবা বিষ্ণুর নবম অবতার বুদ্ধরূপে গণ্য হন। মহারাষ্ট্রের সন্তকবিরাও বিঠোবাকে বুদ্ধের রূপে বন্দনা করেছেন।
বিষ্ণুর দশাবতার শুধু আধ্যাত্ম চর্চা নয়, ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ। শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা থেকে দৈনন্দিন জীবন- সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
বিষ্ণুর প্রথম চার লীলা অবতারের জন্ম হয়েছে সত্য যুগে। পরের তিন অবতারের আবির্ভাব ত্রেতা যুগে। অষ্টম এবং নবম অবতারের আগমন ঘটে দ্বাপর এবং কলি যুগে। বিষ্ণুর দশম অবতার কলি যুগে। ৪২৭,০০০ হাজার বছর পর কলিযুগের একেবারে শেষে তাঁর আগমন ঘটবে। কল্কিদেব দুষ্টের নিধন ধরার বুকে ফের সত্যযুগ ফিরিয়ে আনবেন বলে হিন্দু বিশ্বাস।
মৎস্য অবতার- মৎস্য ভগবান বিষ্ণুর প্রথম অবতার রূপ। এই অবতার রূপে সত্যযুগে বিষ্ণুর আবির্ভাব। পুরাণ অনুযায়ী পৃথিবীর প্রথম মানুষ মনুকে এক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে মৎস্য রূপে বিষ্ণু আবির্ভূত হন।
কূর্ম অবতার- কূর্ম ভগবান বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার। সত্যযুগে এই অবতার রূপে বিষ্ণু আবির্ভূত হন। পুরাণে বলা হয় সমুদ্রমন্থনের সময়, মন্থন কালে মন্দর পর্বত সমুদ্রের নীচে ডুকে যাচ্ছিল। তাই সেই সময় বিষ্ণু কূর্ম অবতার অর্থাৎ কচ্চপের রূপে আবির্ভূত হয়ে পর্বত তাঁর পৃষ্ঠে ধারণ করেন। যার ফলে অমৃত প্রাপ্তি সম্পূর্ণ হয়।
বরাহ অবতার- বন্য শূকরের রূপ ধারণ করেছিলেন ভগবান বিষ্ণু। এটি তাঁর তৃতীয় অবতার। বরাহ অবতারে তিনি সত্য যুগে আবির্ভূত হন। পুরাণ মতে পৃথিবীকে হিরণ্যাক্ষ নামক মহাশক্তিশালী অসুরের হাত থেকে রক্ষা করতে এই অবতার রূপে বিষ্ণু আসেন। অসুর পৃথিবীকে মহাজাগতিক সমুদ্রের নীচে লুকিয়ে রেখেছিলেন। বরাহ রুপী বিষ্ণু হিরণ্যাক্ষের সাথে ক্রমাগত হাজার বছর যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করেন ও মারেন। তারপর পৃথিবীকে মহাজাগতিক সমুদ্রের নীচ থেকে তুলে আনেন। প্রলয়ের পর পৃথিবীর নতুন জন্মের প্রতীক মানা হয় বরাহ অবতারকে।
নরসিংহ অবতার- অর্ধেক মানব ও অর্ধেক সিংহ। সত্যযুগে অবতীর্ণ হয় এই অবতার। দেহ মানুষের মত কিন্তু মাথা সিংহের মত। রাক্ষস হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণু ভক্ত। হিরণ্যকশিপু ছিলেন বিষ্ণু বিরোধী। কারন তাঁর ভাই হিরণ্যাক্ষকে বধ করেছিলেন বিষ্ণু বরাহ রূপে। হিরণ্যকশিপু তাঁর পুত্র প্রহ্লাদকে বিষ্ণুর ভক্ত হওয়ার সাজা স্বরূপ বধ করতে চাইলে শেষমেশ নৃসিংহ অবতারে বিষ্ণু অবতীর্ণ হন। তিনি বধ করেন হিরণ্যকশিপুক।
বামন অবতার- বামন রূপে ভগবান বিষ্ণু ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ হন। এটি তাঁর পঞ্চম অবতার। অসুর বলিকে দমনের উদ্দেশ্যে বামন অবতার রূপে বিষ্ণু জন্ম নেন। অসুর অধিপতি বলে একটি যজ্ঞয়ের আয়োজন করলে বামন সেখানে হাজির হয়ে তিন পা রাখার মত জমি চান। বলি বামনকে জমি দিতে রাজি হয়ে যান। সেই সময় বামন তাঁর দেহ বর্ধিত করে বিশালাকার বিষ্ণু রূপ ধারণ করেন। স্বর্গ ও মর্ত জুড়ে দু পা রাখেন। আর তাঁর পেট চিরে বেরিয়ে আসা একপা রাখার জায়গা চাইলে বলি তাঁর মাথা পেতে দেন টা রাখার জন্য। তৃতীয় পা বলির মাথায় রাখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পাতালে প্রবেশ করেন।
পরশুরাম অবতার- পরশুরাম বিষ্ণুর ষষ্ট অবতার। ত্রেতা ও দ্বাপর যুগ মিলিয়ে তিনি ছিলেন। পরশুরাম ছিলেন ব্রাহ্মণ জমদগ্নি ও ক্ষত্রিয় রেনুকার পুত্র। পরশুরাম কঠোর তপস্যা করে শিবের থেকে যুদ্ধ বিদ্যা শেখেন। প্রথম যোদ্ধা সন্ত ছিলেন তিনি।
রাম অবতার- রাম ছিলেন সপ্তম অবতার। ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ হন তিনি।
কৃষ্ণ অবতার- দ্বাপর যুগে অন্যায়ের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে কৃষ্ণের আবির্ভাব। বিষ্ণুর অষ্টম অবতার বলে মানা হয় তাকে।
বুদ্ধ অবতার- গৌতম বুদ্ধকে বিষ্ণুর নবম অবতার মনে করা হয়। কলিযুগে অবতীর্ণ হন তিনি।
কল্কি অবতার- বিষ্ণুর দশাবতারের সর্বশেষ অবতার কল্কি। কলি যুগের শেষে তাঁর আবির্ভাব হবে বলে মনে করা হয়। পুরাণ মতে সাদা ঘোড়ায় তলোয়ার হাতে আবির্ভূত হবেন বিষ্ণু কল্কি রূপে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে দশাবতার মন্দির। তবে উত্তরপ্রদেশের দেওঘরে অবস্থিত দশাবতারম মন্দিরটি সর্বাধিক জনপ্রিয়।
এই মন্দির গড়ে উঠেছিল গুপ্ত যুগে। গুপ্ত যুগের স্থাপত্যরীতিতে গড়ে তোলা হয় পাথরের মন্দির। মন্দিরে শিখরে চূড়া ছিল। মন্দিরের প্রধান দেবতা বিষ্ণু হলেও মহাদেব, হর পার্বতীও পূজিত হন।
ভারতে লোক সংস্কৃতিতে ভীষণভাবে জড়িয়ে আছে বিষ্ণুর দশাবতারের গাথা। আট হাজার বছর ধরে চলে আসছে এই সংস্কৃতির ধারা। ভারেতের বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্বতা মিশেছে কাহিনিতে। বিশেষ করে মহারাষ্ট্র এবং গোয়াতে দশাবতারের নাট্যরূপ অত্যন্ত লোকপ্রিয়। প্রাচীন মন্দিরগুলির উৎসবে পরিবেশত হয় দশাবতার আখ্যান।
দশাবতারের প্রতিটি অবতার ভিন্ন দর্শনের পাঠ দেয়। কাহিনিও মন টানে। লোককথা হিসেবে মানুষের মুখে মুখে ফেরে। একবার শুনলেও কানে এবং মনে থেকে যায়। এক এক অবতারকে কেন্দ্র করে আবার আলাদা আলাদা উৎসবের জন্ম হয়েছে।