দেবী পার্বতীর মানভঞ্জন কীভাবে করেছিলেন দেবাদিদেব?

বিশেষ দেবকার্য সাধনের জন্য দেবী পার্বতীর নিন্দা করতে বাধ্য হয়েছিলেন স্বয়ং মহাদেব। জীবের বন্ধন ও মুক্তি যার হাতে সেই দেবাদিদেব সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার দেওয়া বরকে সার্থক করতে ও এই জগত থেকে অসুর  দমন করবার জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও দেবী পার্বতীর গাত্রবর্ণের নিন্দা করেছিলেন আর সমগ্র জগতের মাতা পার্বতী, যিনি মহামায়া, তিনিও মহাদেবের বক্তব্যর মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রকৃত উদ্দেশ্য উপলব্ধি না করে, তার মুখে নিজের কৃষ্ণবর্ণের নিন্দা শুনে মহাদেবের প্রতি অভিমান করে কৈলাস ত্যাগ করেন। এরপর দেবী কঠোর তপস্যায় ব্রতী হন এবং তপস্যার প্রভাবে নিজের কৃষ্ণবর্ণ ত্যাগ করে গৌরী হয়ে ওঠেন।

দীর্ঘ তপস্যার প্রভাবে কৃষ্ণবর্ণ ত্যাগ করে গৌরী হওয়ার পরে তিনি তপস্যা কালীনসময়ে তার সঙ্গে থাকা ব্যাঘ্রের প্রতি সদয় হয়ে তাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলেন। এরপর দেবী হিমালয় গিয়ে নিজের পিতা মাতাকে প্রণাম করেন ও নিজের সখীদের নিয়ে কৈলাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন স্বামীকে দর্শনের জন্য। দেবী পার্বতী কৈলাসে গমন করার পরে মহাদেব নিজে দেবীর মানভঞ্জন করেছিলেন।

দেবী পার্বতী কৈলাসে গমন করলে দ্বারপালগণ দেবীর বন্দনা শুরু করেন এরপর দেবী তার স্বামী মহেশ্বরকে প্রণাম করলে মহাদেব দেবীর হাত ধরে আনন্দের সঙ্গে দেবীকে আলিঙ্গন করেন। এরপর দেবীকে নিজের কাছে বসিয়ে দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে মহাদেব বলেন, "হে সর্বাঙ্গ সুন্দরী তুমি যখন ইচ্ছা ক্রমে যে কোন বর্ণ ধারণ করতে পারো তখন তোমার তপস্যার কোন প্রয়োজন ছিল না। হে দেবী কেন তুমি তোমার স্বরূপ বিস্মৃত হয়েছিলে? আমি অগ্নির মস্তকে স্থিত তুমি সোম বা চন্দ্রের মস্তকে স্থিত। আমরা দুজনে এই অগ্নিসোমাত্বক বিশ্বকে ধারণ করে আছি। আমরা দুজনে জগতের হিতের জন্য শরীর ধারণ করে ইচ্ছানুসারে বিচরণ করে থাকি। আমাদের উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে এই জগৎ আশ্রয় শূন্য হয়। আমি নিজের ইচ্ছায় এই জগতের সৃষ্টি বা সংহার করি না। আজ্ঞাবশেই করি, তুমিই সেই আজ্ঞা। তুমি আমার সকল ঐশ্বর্য্যের সার। আমি আজ্ঞা শূন্য হলে আমার কোন ঐশ্বর্য থাকে না। পরস্পর বিযুক্ত হয়ে কখনই আমরা থাকতে পারি না। তথাপি আমাদের মধ্যে কিছুকালের জন্য যে বিরহ ঘটেছে তা আশ্চর্যের ব্যাপার। এই সংসারের প্রতি অনুগ্রহ ভিন্ন আমাদের নিজেদের কোন প্রবৃত্তি নেই। অতএব আমাদের ক্রীড়া কৌতুক‌ও বৃথা হয় না। দেবতাদের কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে আমি তোমাকে পরিহাস করেছিলাম। তোমার তা অবিদিত নেই। তবে কেন ক্রোধ করেছিলে?"

মহাদেব আরও বললেন যে, "তুমি নিশ্চয়ই ত্রিলোকের রক্ষার জন্য আমার ওপর ভর করেছ। যাতে জীবনের অনর্থ হয় এমন কাজ তুমি কখনই করতে পারো না।"  

দেবাদিদেব এর এই স্তুতি বাক্যে দেবী খুশি হয়ে তার বর্ণ কোষ থেকে উৎপন্ন হওয়া দেবী কৌশিকীর জন্ম বৃত্তান্ত বললেন। এরপর দেবী বললেন, "কৌশিকী নামে আমি যে কন্যা সৃষ্টি করেছি তাকে আপনি দেখেননি। এ সংসারে তার মতো কন্যা কখনও হয়নি বা হবে না। সে সাক্ষাৎ শক্তিরূপিণী ও করুণাময়ী। তার বীর্য, বল, বিন্ধ্যাচলে নিবাস, বিজয়, যুদ্ধে শুম্ভ ও নিশুম্ভ বধ,  সেবক জনকে প্রত্যক্ষ ফল দান- এই সকল বিষয় ব্রহ্মা আপনাকে অবশ্যই নিবেদন করবেন।”

এরপর দেবী তাঁর অনুগ্রহপ্রাপ্ত সেই বাঘকে মহাদেবের সামনে এনে বললেন, এই বাঘকে দেখুন এর মত উপাসক আর কেউ নেই। এই বাঘ দুষ্ট বিঘ্নকারীদের হাত থেকে আমার তপোবনকে রক্ষা করেছে। এই আমার একান্ত ভক্ত এবং বিশ্বাসের পাত্র। এ আমাদের অনুগ্রহ লাভের জন্য নিজের হিংসাভাব পরিত্যাগ করে এসেছে। যদি আমার দ্বারা আপনি প্রীত হন এবং আমার প্রিয়কারী যদি আপনার প্রতি প্রীত হয়, তবে হে ঈশ্বর আমার অন্তপুরে দ্বাররক্ষক হিসেবে এই বাঘ নিযুক্ত হোক।

পার্বতীর কথা শুনে মহাদেব বললেন আমি প্রীত হলাম এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সেই বাঘটি সুবর্ণ নির্মিত বেত্র দন্ড, রত্নখচিত কঞ্চুক ও সর্প বধ ছুরিকাধারী গণরক্ষকে পরিণত হলেন। তার নতুন নামকরণ হলো সোমনন্দী। মহাদেব দেবীর প্রিয় কার্য করার সঙ্গে সঙ্গে তাকে নানান রকম রত্ন ও অলঙ্কারে ভূষিত করলেন। দেবাদিদেব কর্তৃক দেবীর এই মানভঞ্জনের বিষয়টি শিব পুরাণের বায়বীয় সংহিতার ষোড়শ অধ্যায়ে উল্লেখিত।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...