কথায় আছে প্রকৃতি সর্বংসহা। প্রকৃতির কাছে নাকি মানুষ অসহায়। কোনওটাই অস্বীকার করার উপায় নেই, তবুও কখনো মানুষের সিদ্ধান্তের কাছে, ভাবনার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় প্রকৃতি। কিন্তু এই সমর্পণের ফলাফল হয় ভয়ঙ্কর।
সময়টা ১৯৪৯ সাল। সবে চীনের ক্ষমতায় এসেছে কমিউনিস্ট পার্টি। মাও সে তু্ং ছিলেন নেতা। সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সঠিক কৃষি পরিচালনা। সরকার চেষ্টা করছিল দেশব্যাপী কৃষি শিল্পকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। এমনকি সেই সময়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ক্ষুদ্র চাষাবাদকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সরকারি তরফে কৃষি বিপ্লবকে সফল করার চেষ্টা চলছিল।
কৃষিশিল্পকে রক্ষা করতে সরকারের প্রথম পদক্ষেপ ছিল ফসল রক্ষা করা। সেই সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কৃষির প্রধান সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা চলছিল। এই সমস্যায় সামনে আসে একটা তথ্য। একটি রিপোর্টে বলা ছিল প্রতি বছর অনেকটা ফসল খেয়ে ফেলে চড়ুই পাখিরা। ফলে নষ্ট হয় ফসল। চিনের বিজ্ঞানীদের রিপোর্ট অনুযায়ী এক বছরের প্রতিটি চড়ুই পাখি প্রায় সাড়ে চার কেজি শস্যদানা খেয়ে ফেলত, যা দিয়ে অনেক মানুষের অন্ন-সংস্থান করা যেত প্রতি বছর।
এই সমস্যার সমাধানে চীনের সরকারের তরফ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয় চড়ুই পাখি হত্যার। ফসল রক্ষার স্বার্থেই সেই সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। চড়ুই পাখির হত্যা করার জন্য রীতিমত গবেষণা চালানো হয়।
গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা দেখেছিলেন চড়ুই পাখিদের নিধন করা সম্ভব জনসাধারণের সাহায্যে। প্রত্যেক চীনা নাগরিক তার কাছের চড়ুই পাখির বাসা খুঁজে সারাদিন পাখিগুলোকে তাড়া করত। চড়ুই পাখিদের মেরে ফেলার পদ্ধতি হিসেবে শব্দের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল।
চড়ুই পাখিদের দেখলেই নানা পদ্ধতিতে বিকট আওয়াজ সৃষ্টি করা হতো। ফলে পাখিগুলো কোথাও নামতে পারত না। উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে যখন তারা নিচে পড়ে যেত তখনই মেরে ফেলতে হতো। এই অভিযানের নাম ছিল 'দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন'। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সেই সময় চড়ুই হত্যার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। সেই সময়কার তথ্য অনুযায়ী কেবল মাত্র সাংহাইতে ১৯৪,৪৩২টি চড়ুই পাখি হত্যা করা হয়েছিল।
চীনে অনেকবার ইঁদুর, মাছি ও মশাও হত্যা করা হয়েছিল। ‘ফোর পেস্টস ক্যাম্পেইন’ নামে পরিচিত ছিল এই প্রকল্প। এইসব অভিযানের লক্ষ্য ছিল স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ গড়ে তোলা। চড়ুই পাখির ক্ষেত্রে বিষয়টা ছিল কৃষি উন্নতি।
কিন্তু এই নিধন কার্যের ফলাফল ছিল মারাত্মক। প্রকৃতির সকল উপাদান এই খাদ্য শৃংখল এবং খাদ্য জালকের অন্তর্ভুক্ত। এদের একজনের জীবন অন্যের উপর নির্ভরশীল। বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে যেকোনো জীবই গুরুত্বপূর্ণ।
তাই প্রকৃতির এই সৃষ্টিকে নির্বিচারে হত্যা করার ফলাফল দেখা গেল খুব কম সময়ের মধ্যেই। চড়ুই পাখি আসলে শস্যদানার পাশাপাশি পোকামাকড়ও খায়। চড়ুই পাখির অনুপস্থিতিতে পোকামাকড়ের সংখ্যা বেড়ে গেলো দ্বিগুণ হারে।
যে ফসল বাঁচাতে চড়ুই পাখি হত্যা করা হয়েছিল, সেই ফসল খেতে শুরু করেছিল পোকামাকড়। খুব অল্পসময়ের মধ্যেই খালি হয়ে গিয়েছিল শস্য ভান্ডার। সাধারণ মানুষের মজুদ করা খাদ্যেও ঘাটতি দেখা গেল। কোটি কোটি মানুষ সংকটের মুখে পড়েছিল। দেখা দিয়েছিল দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষই 'দ্য গ্রেট ফেমিন' নামে পরিচিত ছিল।
দুর্ভিক্ষের সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে আসে দুর্ভাগ্য। এই সময় একটি অভিযান শুরু করেছিল চীন। 'দ্য গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড'। ১৯৫৯ সালের এপ্রিলে সরকারের পক্ষ থেকে জনসাধারণকে স্টিল তৈরীর নির্দেশ দেওয়া হয়। চীনের গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত হওয়া লোহার পাত্র, থালা, বাটি, প্লেটের ব্যবহার বন্ধ করা হয়। কৃষি কাজের প্রতি মনোযোগ সরে যায়। দুর্ভিক্ষ ততদিনে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। প্রায় দেড় কোটিরও বেশী মানুষ খাদ্য সংকটের মুখে পড়েছিল।
পরিবেশবিদরা একে প্রকৃতির অভিশাপ হিসেবেই মনে করেন। প্রকৃতির সৃষ্টিকে পৃথিবীর বুক থেকে সরানোর নির্মম প্রচেষ্টার ভয়ঙ্কর ফল।
ধীরে ধীরে প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে চড়ুই পাখি। রজনীকান্ত সেনের 'স্বাধীনতার সুখ' কবিতার চড়ুইয়ের অট্টালিকার অহংকার মাটিতে মিশেছে মানুষেরই পরিবেশবিরোধী ব্যবহারে।
২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর ২০শে মার্চ বিশ্ব চড়ুই দিবস হিসেবে পালিত হয়। চড়ুই পাখিরা বর্তমানে বিপন্ন প্রজাতি। চড়ুই পরিবেশবান্ধব, কৃষকবান্ধব পাখি। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে বর্তমানে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে চড়ুইদের রক্ষা করার জন্য। কিন্তু অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। পরিবেশ ও তার সৃষ্টির প্রতি অনেকটা যত্নবান হওয়া প্রয়োজন এখনো।