ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিকেই শিব পুরাণে মহা শিবরাত্রি বলা হয়। এই দিন সকল শৈব ভক্তরা দেবাদিদেব মহাদেবকে প্রসন্ন করতে উপবাস রাখেন। তবে দেবাদিদেব মহাদেবকে যেহেতু পরম বৈষ্ণব এবং ভগবান নারায়ণের একনিষ্ঠ ভক্ত হিসেবে বর্ণিত করা হয় সেই কারণে বৈষ্ণবরাও কৃষ্ণ ভক্তি লাভের অভিপ্রায় মহা শিবরাত্রি ব্রতানুষ্ঠান করেন। মহাদেবকে বলা হয় আশুতোষ অর্থাৎ তিনি খুব অল্পেই তুষ্ট হন, তাই শিবরাত্রির দিন যে ভক্ত শুদ্ধ মনে তার উপাসনা করেন, দেবাদিদেব মহাদেব তার সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। পুরানে বলা হয় যদি প্রতিদিন দেবাদিদেব মহাদেবের পঞ্চাক্ষর বীজ মন্ত্র জপ করা হয় তবে তিনি অতি সহজেই সন্তুষ্ট হন। এই পঞ্চাক্ষর বীজ মন্ত্র হলো 'নমঃ শিবায়'। তাই শিবরাত্রির দিন নির্জলা উপবাস রাখুন বা সরবত পান করে উপবাস রাখুন, সারাদিন মনে মনে অবশ্যই চেষ্টা করুন দেবাদিদেব মহাদেবের উপরিউক্ত পঞ্চাক্ষর মন্ত্র জপ করতে।
আমাদের সনাতন শাস্ত্রে বলা হয়, ঈশ্বর হলেন অন্তর্যামী অর্থাৎ তিনি আমাদের অন্তরে বাস করেন এবং আমাদের অন্তরের মধ্যে লুক্কায়িত সকল কামনা-বাসনার কথা তিনি জানেন। তাই তাকে প্রশ্ন করতে গেলে অবশ্যই মনটাকে শুদ্ধ করতে হবে, মনকে হিংসা, বিদ্বেষ, পাপের মতো কলুষতা থেকে মুক্ত করতে হবে, কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ সারাটা দিনে হাজারটা হাজার রকমের চিন্তা আমাদেরকে তাড়িত করে। তাই মনের মধ্যে নানান রকম কু চিন্তাও বাসা বাঁধে, সেই কোন চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে যদি সকাল থেকে রাত অবধি শিবরাত্রির দিন ভগবানের নাম জপ করেন তাহলে মনের মধ্যে সেই অবসরই সৃষ্টি হবে না, যার মধ্য দিয়ে কোন চিন্তা প্রবেশ করবে।
শিবরাত্রি পালনের বিধি নিয়ম-
এই বছর মহা শিবরাত্রির তিথি ১৮ ফেব্রুয়ারি। এই ব্রত পালনেও কিছু নিয়ম পালন করতে হয় ভক্তদের।
১। মহা শিবরাত্রির আগে অর্থাৎ ত্রয়োদশী তিথি থেকেই ভক্তরা শিবরাত্রি পালনের প্রস্তুতি নেন। ত্রয়োদশী তিথির দিন অনেকেই মহা শিবরাত্রি ব্রত পালন বিধি অনুযায়ী এক বেলা নিরামিষ আহার করেন। যাতে পরদিন ব্রতানুষ্ঠান করার সময় উদরে এতোটুকুও খাবারের কনা না থাকে। যারা এই নিয়ম পালন করতে পারেন না তারা মহা শিবরাত্রি আগের দিন নিরামিষ খাবার খান সারাদিন ধরেই।
২। মহা শিবরাত্রির দিন সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠতে হয়। শিব পুরাণ মতে এই দিন কালো তিল ভেজা জলে স্নান করলে শরীর শুদ্ধ হয়।
৩। স্নান হয়ে গেলে শিবরাত্রির সংকল্প গ্রহণ করুন, মনে মনে দেবাদিদেব মহাদেবের প্রতি প্রণাম জানিয়ে তার কাছে সংকল্প করুন যে, চতুর্দশীর সারাদিন এবং সারারাত আপনি শুদ্ধ শরীর ও মনে থাকবেন।
৪।অনেকেই মহা শিবরাত্রির পুজো দুপুরের মধ্যেই সেরে নেন, কিন্তু নিয়ম হলো সারারাত ধরে এই পুজো করা। তাই যদি আপনি রাত্রেও দেবাদিদেব মহাদেবের চার প্রহরে পূজা করতে চান তাহলে সন্ধ্যেবেলাতেও একবার স্নান করে শুদ্ধভাবে পুজোর জোগাড় করতে হবে। যদি আপনি গঙ্গা মাটি দিয়ে শিবলিঙ্গ প্রস্তুত করেন তাহলে অবশ্যই মাথায় রাখবেন এক প্রহরের পূজিত শিবলিঙ্গ অপর প্রহরে পূজিত হবেন না! আর যদি গঙ্গা মাটি না পান বা শিবলিঙ্গ বানাতে না পারেন সে ক্ষেত্রে একটাই লিঙ্গ আধারে পূজা করবেন।
৫। মহা শিবরাত্রির পুজোর শুরুতে প্রথমে দেবাদিদেব মহাদেবের লিঙ্গের অভিষেক করান অর্থাৎ লিঙ্গকে স্নান করান। এরপর প্রথম প্রহরে 'হৌঁ ঈশাণায় নমঃ' মন্ত্রে দুধ দিয়ে,দ্বিতীয় প্রহরে ' হৌঁ অঘোরায় নমঃ' মন্ত্রে দই দিয়ে শিবলিঙ্গের স্নান করিয়ে পুজো করতে হয়। শিবরাত্রির তৃতীয় প্রহরে 'হৌঁ বামদেবায় নমঃ'মন্ত্রে ঘি দিয়ে লিঙ্গের স্নান করিয়ে চতুর্থ প্রহরে 'হৌঁ সদ্যোজাতায় নমঃ' মন্ত্রে মধু দিয়ে স্নান করিয়ে পুজো করতে হয়। -
চার প্রহরে চারবার যখন দুধ,দই, ঘি ও মধু দিয়ে দেবাদিদেব মহাদেব কে স্নান করানো হবে সেই সময় ভক্ত দেবাদিদেদেব মহাদেবের কাছে প্রার্থনা করবেন নিজের সৌভাগ্য, আরোগ্য, বিদ্যা, অর্থ,কাম, স্বর্গ, সন্তান ও আয়ুর জন্য।
৬। শিব লিঙ্গের অভিষেক হয়ে গেলে চার প্রহরে চার বার ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রে শিবকে চারপ্রহরে চারটি অর্ঘ্য প্রদান করতে হয়।
প্রথম প্রহরের অর্ঘ্য মন্ত্রটি হলো-
"ওঁ শিবরাত্রি ব্রতং দেব পূজাজপপরায়ণঃ।
করোমি বিধিবত্তং গৃহাণার্ঘ্যং মহেশ্বরঃ।।"
দ্বিতীয় প্রহরের অর্ঘ্য মন্ত্রটি হলো -
"ওঁ নমঃ শিবায় শান্তাায় সর্ব্বপাপহরায় চ।
শিবরাত্রৌ দদামর্ঘ্যং প্রসীদ উময়া সহ।।"
তৃতীয় প্রহরের অর্ঘ্য মন্ত্রটি হলো-
"ওঁ দুঃখদারিদ্রশোকেন দগ্ধোঽহং পার্বতীশ্বর।
শিবরাত্রৌ দদামর্ঘ্যং উমাকান্তং প্রসীদ মে।।"
চতুর্থ প্রহরের অর্ঘ্য মন্ত্রটি হলো-
"ওঁ মমকৃত্যান্যনেকানি পাপানি হর শঙ্কর।
শিবরাত্রৌ দদামর্ঘ্যং উমাকান্তং গৃহাণ্ মে।।"
৭। অর্ঘ্য প্রদান হয়ে গেলে শিব লিঙ্গ ফুল দিন, চন্দন বাটার প্রলেপ ও সিঁদুরের প্রলেপ লাগান। ধূপ ও ঘিয়ের প্রদীপ দেখান আশুতোষ এর উদ্দেশ্যে ও 'নমঃ শিবায়ঃ' মন্ত্রে মহাদেবের আরতি করুন। এই আরতি শেষে শিবকে ফল ও মিষ্টি নিবেদন করুন।
৮।পারলে আজকের দিনে দেবাদিদেবের অষ্টোত্তর শতনাম পাঠ করুন
৯। মহাশিবরাত্রির পর দিন সূর্যোদয়ের আগেই স্নান করে কোনো ব্রাহ্মণের থেকে শিব রাত্রির ব্রত কথা শুনে দক্ষিণা দিয়ে উপোস ভঙ্গ করুন। মনে রাখবেন, এক্ষেত্রে চতুর্দশী তিথি থাকতে থাকতে উপবাস ভঙ্গ করতে হবে।