“রসের গোলক, এত রস কেন তুমি ধরেছিলে হায় ।
ইতালির দেশ ধর্ম ভুলিয়া লুটাইল তব পায়”
এই ছন্দ আদরের এক রস গোলকের জন্য বরাদ্দ করেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী।রসের গোলকটি যে কী তা বোধহয় বলে দিতে হয় না কাউকে। রসগোল্লা এতটাই প্রিয় ছিল যে ‘রসগোল্লা’ নামে আস্ত একখানা গল্পই লিখে ফেলেছিলেন মুজতবা সাহেব।
এক টিন রসগোল্লাকে কেন্দ্র করে ভেনিস বন্দরে যে ধুন্ধুমার কান্ড হয়েছিল তাই উঠে এসেছিল সেই গল্পে। এক ভিনদেশি এয়ারপোর্টে এই গোলাকার রসবস্তুটির কাছে জাতি ভাষা নির্বিশেষে সবাই কীভাবে বশ্যতা মানল তাই গল্পের সারমর্ম। তবে গল্প বোধহয় শুধু গল্প নয়। তা বাস্তবের আয়না।
যেমন রসগোল্লা কার সে নিয়ে লড়াই শুরু হয়েছিল বঙ্গ আর কলিঙ্গের মধ্যে। স্বত্ব নিয়ে টানাপোড়েন।
কলিঙ্গ প্রদেশ অর্থাৎ উড়িষ্যার দাবী ছিল গত ৮০০ বছর ধরে উড়িষ্যায় রসগোল্লার চলছিল। সে কাহিনী মহাপ্রভু জগন্নাথের সঙ্গে জড়িয়ে।
শোনা যায়, রথযাত্রা শেষে সাত দিন মাসির বাড়িতে থেকে পুরী মন্দিরে ফেরার সময় রসগোল্লা নিয়েই ফিরতে হতো। দেবী লক্ষ্মীর মান ভঞ্জন করে তবে মিলত মন্দিরে ঢোকার ছাড়পত্র। হাঁড়ি ভর্তি রসগোল্লা দিয়ে তবেই ঘরে ফেরা।
তবে তাদের এই দাবী ঐতিহাসিকদের কাছে অযৌক্তিক ঠেকেছিল, কারণ সেই সময় পুরীর মন্দিরে ভোগ দেওয়া হতো ক্ষীরমোহন দিয়ে। ক্ষীর
মোহন ছানা দিয়ে তৈরি হতো ক্ষীর দিয়ে, যা দুধ জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হতো। ছানা দিয়ে নয়।
বাংলায় রসগোল্লার জন্ম কাহিনী হিসেবে যে গল্প ছড়িয়ে আছে তা বেশ মজার।
১৫০ বছর আগে নবীনচন্দ্র দাশ রসগোল্লা আবিষ্কার করেছিলেন। সালটা ১৮৬৮।
চটচটে নয়, শুকনো হতে মানা
দেখতে হবে ধপধপে চাঁদপানা
এমন মিষ্টি ভূ-ভারতে নাই,
নবীন ময়রা এমন মিষ্টি চাই।
শোনা যায় এক বালিকার এহেন অনুরোধ রাখতে গিয়ে নবীনচন্দ্র দাশ তৈরি করে ফেলেন চিনির রসে টইটুম্বুর ধপধপে সাদা ছানার গোলক।
সেই বালিকার নাম ছিল ‘ক্ষীরদমনি’। বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রার মেয়ে।পরবর্তী সময়ে তিনি নবীনচন্দ্র দাশের সহধর্মিনী হয়ে আসেন।
তবে নবীন চন্দ্র দাশ কিভাবে রসগোল্লা আবিষ্কার করলেন সে নিয়ে আরো একটি মত শোনা যায়, এবং এই মতটিই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয়। তথ্য মতে, নবীন চন্দ্র দাস ছিলেন আদতে চিনি ব্যবসায়ী।
১৮৬৪ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকোতে একটি মিষ্টির দোকান শুরু করেন। দোকানটি বেশিদিন না চলায় ১৮৬৬ সালে কলকাতার বাগবাজারে আরেকটি মিষ্টির দোকান চালু করেন তাঁর নিজের বাড়িতে। এই দোকানটির প্রধান মিষ্টি ছিল সন্দেশ। এক সময় কলকাতার ‘রইস’ বণিকদের জন্য নতুন মিষ্টি তৈরির কথা ভাবনাচিন্তা আসে মাথায়। দুই বছরের চেষ্টায় উদ্ভাবন করে ফেলেন সম্পূর্ণ নতুন এক মিষ্টি। গরুর দুধ থেকে ছানা কেটে সেই ছানা রসে ডুবিয়ে । নাম দেন ‘রসগোল্লা’।
এই গল্প এখানেই শেষ হয়ে যায় না। শোনা যায় ভগবান দাশ নামে এক ধনী ব্যবসায়ী বাগবাজারে ওই দোকানের সামনে ঘোড়াগাড়ি করে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে তাঁর ছেলেও ছিল। রাস্তার মধ্যে তেষ্টা পাওয়ায় গাড়ি দাঁড়িয়ে নেমে আসেন সেই অখ্যাত মিষ্টির দোকানটিতে। জল চাইলে তাকে জলের সঙ্গে গোলাকার ছানার মিষ্টি দেওয়া হয়। বাবা-ছেলে দুজনেই স্বাদে মোহিত হয়ে যান। যাবার সময় সেই নতুন ধরনের মিষ্টিও সঙ্গে নেন এক হাঁড়ি। তারপরই ধীরে ধীরে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আড়াই বছর মামলা চলার পর সরকারী ভাবে রসগোল্লার জন্মভূমি হিসেবে স্বীকৃতি পায় পশ্চিমবঙ্গ। মেলে জিআই এর স্বীকৃতি।
সেই দিনটিই এবঙ্গে ‘রসগোল্লা’ দিবস হিসেবে উদযাপনের দিন ধার্য করা হয়।
রসগোল্লা।রোশোগোল্লা। রাজগোল্লা।রাশবাড়ি। নাম অনেক। বস্তু একটাই। আর তাকে ঘিরেই আদরের অন্ত নেই মিষ্টিপ্রেমীদের।