চিরন্তন শান্তিনিকেতন। বারবার টানে। রাঙা মাটির দেশ। রবিঠাকুরের দেশ। ঋতুতে ঋতুতে বদলে যায় তার রূপ।
খোয়াই। কোপাই। ভুবনডাঙা। সোনাঝুরি। রবীন্দ্রনাথ। বাউল গান। সব মিলিয়ে ফিরে আসার টান নিয়ম মানে না। অতিমারী আর লকডাউনে লম্বা সময় ঘরবন্দী ছিলাম। দিন যত এগিয়েছে তত বেড়েছে ছটফটানি। শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে পড়ার সুযোগ এলো।
করোনা বদলে দিয়েছে চেনা সব কিছু। কিন্তু বদলায়নি শান্তিনিকেতন। ২৬ অগাস্ট সকালে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। আমরা মানে আমরা চারজন। আমি আর আমার তিন বান্ধবী। আটটার সময় গাড়ি ছাড়ল কলকাতা থেকে।
কতদিন পর বন্দিদশা থেকে যেন মুক্তি! কলকাতার সীমা ছাড়াতেই মনটা বদলাতে শুরু করে প্রতিবার। এবার সেই বদলটা যেন আরও বেশি করে অনুভব করতে পারলাম। রোজকার একঘেঁয়েমি কীভাবে মনের ওপর চেপে বসে, ঘরে থাকতে থাকতে সেটা ঠিক বোঝা যায় না, বোঝা যায় ট্যুরের সময়।
আমাদের গাড়ি চলতে লাগল পক্ষ্মীরাজের গতিতে। পাশ দিয়ে সরে সরে যায় মানুষ, গ্রাম, জেলা। বারির ভিতর ছোটবেলার হইহই। শুধু তো বেড়াতে যাওয়া নয়, বন্ধু আছে, আড্ডা আছে, হইচই আছে...সব মিলিয়ে সফর সুহানা সন্দেহ নেই...
আমরা প্রথম থামলাম শক্তিগড়ে এসে। বর্ধমান দিয়ে যাব আর শক্তিগড়ে মিষ্টিমুখ হবে না তা কী হয়!
শান্তিনিকেতন যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য মধ্যাহ্নে। ঘড়ির কাঁটা ১২ঃ৩০ পার করে ফেলেছে। ‘শান্তবিতান ট্যুরিস্ট লজে’ যখন চেক-ইন করলাম তখন ক্লান্তিটা যেন একটু একটু ছুঁতে শুরু করেছে।
আমাদের যাওয়ার আগে হালকা টেনশন ছিল করোনা বিধি আর ভ্যাকসিন ডোজ নিয়ে হোটেল বা অন্যত্র কী পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে। তবে সেরকম প্রবল বাড়াবাড়ির মুখে পড়তে হয়নি। মাস্ক, স্যানেটাইজার সঙ্গী থাকলে কোনও অসুবিধা নেই।
আমরা খুব একটা দেরী করলাম না। লাঞ্চ সেরে একটু আড্ডা আর ভাতঘুম। বিকেলে ফের বেরিয়ে পড়লাম। ঘুরতে ঘুরতে গেলাম আমার এক বান্ধবীর সহপাঠিনীর বাড়ি। জায়গাটার নামও ভারী সুন্দর। ‘বোনের পুকুর ডাঙা’।
পাঠভবনের শিক্ষিকা। স্বামী চিত্রশিল্পী। পাশাপাশি দুটো বাড়ি ওদের। একটা পুরনো। আর একটা নতুন।
পুরনো বাড়িটা মাটির তৈরি। সেই বাড়ির দেওয়াল শিল্পী-হাতে বানানো। দেওয়াল কই, আসলে তো পোড়ামাটির ম্যুরাল। গ্রাম জীবনের চেনা ছবিই ধরা দিয়েছে অচেনা গল্প হয়ে। দেখলে চোখ আপনি খুশি হয়ে ওঠে।
মাটির বাড়ির পাশেই তিনতলা নতুন বাড়ি। নাম ‘স্বপ্নের বাসা’। গোটা বাড়ির সাজে শান্তিনিকেতনী ছোঁয়া। সামনের বাগানে ফুল গাছের সাম্রাজ্য। সবুজ আর সবুজ। সে দিকে তাকালে নরম স্নিগ্ধতায় শান্ত হয়ে যায় মন। ইচ্ছে করে দু’দন্ড বসি...
সারা বাড়িতেই ছড়িয়ে আছে সেই স্নিগ্ধতা। ঘুরে দেখে মনে হয় এ বাড়ি শুধু বাড়ি নয়, আসলে বাসা। কী ভীষণ সার্থকনামা নীড়...
আমাদের ছুটি খুব বেশি দিনের ছিল না। উইকএন্ড ট্রিপ। শুক্র থেকে রবি, হুশ করে কখন যে ফুরিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না...
ঘরে ফেরার গান বেজে উঠলেও শান্তিনিকেতনের মায়া থেকেই যায়। তার টানে আবার ফিরে আসার আশা...
তথ্য ও ছবিঃ সুরঞ্জনা পাল