এখন বিয়ে বা অন্নপ্রাশন বা অন্য যে কোনও কাজে নিমন্ত্রণ কার্ড পাঠানো হয়। কখনও হাতে, কখনও পশ্তে আবার ইমেল, হোয়াটসঅ্যাপ এসবও আছে। কিন্তু পুরনো দিনে এসব ভাবাই যেত না। ডাক ব্যবস্থা দুর্বল। কাগজ দুর্লভ। তারওপর বিলিতি জিনিস। নিমন্ত্রণ পত্র বা সন্দেশ লেখা হত ‘তুলোট’ কাগজে। তুলো, পাট বা শন, গাছের বাকল দিয়ে তৈরি হত এই কাগজ। পুঁথি লেখার কাজ চলত তা দিয়ে। সেই কাগজেই শুভকাজের বার্তা বা সন্দেশ পাঠানো হত।
হলুদ রঙের সেই কাগজের ওপর লিখতে হত লাল কালিতে। ভাঁজ করে বাঁধা হত লাল সুতো দিয়ে। তখনকার দিনে ধনী বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে ‘বাঁধা- নাপিত’ থাকত। তার হাতে দেওয়া হত সেই পত্রটি। সঙ্গে মিষ্টি। জাত-পাতের হাজার এক বাধায় বন্দি সমাজে নাপিতকে একমাত্র ‘শুদ্ধ’ মানা হত।
নাপিত পৌঁছে দিয়ে আসত পত্র। দূরের আত্মীয়দের কাছেও সে-ই যেত দূত হিসেবে। নাপিতকে যে মিষ্টির হাঁড়ি দেওয়া হত তার মুখ সরা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হত। সরা যাতে সরে না যায় বা রাস্তাঘাটে কেউ যাতে সেই মিষ্টি খেয়ে নিতে না পরে তার জন্য সরার চারদিকে ময়দার প্রলেপ লাগিয়ে দেওয়া হত। যাকে বলা হত ‘ওলপ’।
এক সময় ঢাক-সহরত বাজিয়েও নিমন্ত্রণের চল ছিল। কিন্তু এভাবে নিমন্ত্রণ শুধু জমিদাররাই করতেন। তাঁদের প্রজাদের।
হলুদ দিয়ে রাঙানো পান সুপারি পাট শাল পাতার মধ্যে দিয়ে পাতাটিকে পুঁটুলির মত বাঁধা হত। আত্মীয়দের বাড়িতে গৃহকর্তার হাতে শালপাতাটি দিয়ে নিমন্ত্রণ করা হত। আবার পান পাতা দিয়েও চলত এই প্রথা।
নিমন্ত্রিত ব্যাক্তির বাড়িতে গিয়ে যদি তাঁকে না পাওয়া যেত তাহলে তিনি যে নিমন্ত্রণ বা ডাক দিতে এসেছেন তা বোঝাবার জন্য ভগবান কৃষ্ণকে সাক্ষী রেখে নিমন্ত্রণ করে আসার প্রথা ছিল। আত্মীয়ের সঙ্গে সম্পর্কে যাতে চিড় না ধরে, ভুল বোঝাবুঝি না হয় তার জন্য এই পন্থা।
এই ছবিটা বদলাতে থাকে বাংলায় ছাপাখানার চল হওয়ার পর। প্রথমে সরকারি কাগজপত্র ছাপা হলেও পরবর্তী কালে তা সাধারণ মানুষের জীবনেও প্রবেশ করল। সেই সময় থেকেই ছাপা খানায় ছাপানো নিমন্ত্রণ পত্রের চল শুরু হয়। বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্রে হলুদের ফোঁটা দেওয়া থাকত। লাল রং বা লাল কালির ব্যবহার বেশি দেখা যেত।এখনও চলে আসছে সেই রীতি।
ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিমন্ত্রণ পত্রের বয়ানেও পরিবর্তন আসে। আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোর বদল ঘটার সঙ্গে সঙ্গে নিমন্ত্রণের রেওয়াজে আইন-কানুনের নিয়ম প্রবেশ করে। ১৯৪২ সাল নাগাদ ভারত সরকার ‘অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন’ জারি করে। তারপর থেকে নিমন্ত্রণ পত্রে ‘ভারত সরকারের অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন প্রযোজ্য’ বা ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন প্রযোজ্য’ লেখা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাদের জন্য খাদ্য মজুদ করতে এরকম আইন জারি করা হয়। সেসময় ৫০ জনের বেশি অতিথিকে নিমন্ত্রণ করা যেত না। ৪২ এর পর আবার ৬৮-তে এই আইন বলবৎ হয়। তখন অতিথিদের সংখ্যা ৫০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১০০ তে।
বাঙালির অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণের ক্ষেত্রে হাজার এক নিয়ম প্রচলিত ছিল। এখন সে সব হারিয়ে গিয়েছে। নিমন্ত্রণপত্র শুধুমাত্র অনুষ্ঠান বা ভোজ সভার আমন্ত্রণ নয়, নিমন্ত্রণ রীতির আনাচে-কানাচে আসলে সমাজ-সংস্কৃতি-অর্থনৈতির ইতিহাস লুকিয়ে আছে।