এক বছর আগে মা হয়েছে পিয়ালী। বাচ্চা এখনও খেতে বড় সমস্যা করে। না খেলেই নিজের মোবাইলখানা অন করে দেয় সে। দিব্যি খেয়ে নেয় বাচ্চা। যখন কাঁদে, ঘ্যানঘ্যান করে তখনও তাকে সামলাবার একটাই সোজা ওষুধ, ‘মোবাইল’।
শিশু এক হোক কিংবা দশ-অনেক বাবা মায়েরই তাকে সামলাবার ওষুধ মোবাইল। তিন মাথা এক হয়ে যায় এক যন্ত্রের কাছে। বাবা-মা থেকে শিশু সবাই একচেটিয়া তার নেশায় মশগুল।
এই নেশাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে করোনা বিপন্ন দু বছরের ঘরবন্দী জীবন। পড়াশোনা থেকে খেলা সবই মোবাইলে। জীবন অনলাইন।
মোবাইল এক দুর্নিবার নেশা। যতই দূরে থাকার চেষ্টা করি না কেন ঠিক হাত চলে যাবেই। অনেকক্ষণ তার থেকে দূরে থাকলে মন নিশপিশ। সকাল থেকে রাত ক্লান্তিহীন। বড়রাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তো ছোটরা!
দিনে প্রায় ৯ ঘন্টার বেশি স্মার্টফোনে আটকে থাকছে শিশুরা। কারুর কারুর ক্ষেত্রে সময়টা বাড়তে বাড়তে সারাদিন। ডিভাইস বদলে দিচ্ছে শিশুদের। বদলে যাচ্ছে তাদের আচরণ, ব্যবহার, মন, মেজাজ সবই। রাগী রুক্ষ মেজাজ, হিংসা, ঘুম না হওয়া, চাপা অবসাদ, ওজন বেড়ে যাওয়া, সামাজিক মেলামেশায় আগ্রহ হারানো, অমনযোগ, কানে শোনার সমস্যা, স্নায়ুর রোগের মতো একাধিক সমস্যায় আক্রান্ত আজকের শৈশব। এক সংকট সব দেশেরই চেনা ছবি।
ট্রেন-ফ্লাইটের টিকিট, ক্যাব ডাকা থেকে শুরু করে খাবারের অর্ডার, গোটা জীবনযাত্রাটাই যেখানে স্মার্টফোন নির্ভর সেখানে কি আদৌ মোবাইল থেকে দূরে রাখা সম্ভব শিশুদের?
আপাত দেখায় ‘অসম্ভব’ বলে মনে হলেও বিশেষজ্ঞরা কিন্তু বলছেন সম্ভব। সঙ্গে প্রয়োজন বাবা-মা কিংবা অভিভাবকদের সচেতন হয়ে ওঠা।
কীভাবে মোবাইল থেকে দূরে রাখবেন শিশু?
১) প্রাণশক্তিতে ভরপুর থাকে শিশুরা। পরিনত বয়সের মানুষের তুলনায় তাদের এনার্জি কয়েকগুণ বেশি। সেই এনার্জিকে সঠিক পথে আনুন। পড়াশোনা বাদেও বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত করে দিন শিশুদের। ব্রেক টাইমে স্ক্রিনে ডুবে না থেকে ফ্রি হ্যান্ড করতে পারে।
২) হোমওয়ার্ক, হাতের কাজ শেষ হলে তবেই পাওয়া যাবে মোবাইল এমন নিয়ম করতে পারেন। ছোট থেকেই কাজের গুরুত্ব বোঝান। বোঝান যে মোবাইলটা প্রয়োজনের, বিনোদনের নয়।
৩) মোবাইল বা মোবাইলের মতো গ্যাজেট কখনও শিশুদের জন্য ভাল রেজাল্ট বা সাফল্যের পুরস্কার হতে পারে না। এমন আবদার, বায়না, দাবীকে প্রশ্রয় দেওয়া শিশুর জন্য ক্ষতিকর।
৪) শিশুরা চ্যালেঞ্জ, রোমাঞ্চ, অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করে। মোবাইলে গেমে থাকে চ্যালেঞ্জ। প্রতি লেভেলে তার মাত্রা বেড়ে যায়। চ্যালেঞ্জ মোবাবিলা করেই শিশুর আনন্দ। সেই উপাদানই মোবাইলের নেশার প্রধান কারণ। বাস্তবের দুনিয়ায় শিশুকে সত্যিকারের রোমাঞ্চের স্বাদ দিন। তাকে সময়-সঙ্গ দিন। মাটি-প্রকৃতির নতুন নতুন অভিজ্ঞতার আনন্দ শিশুকে পৃথিবী চেনাবে।
৫) স্কুলে যতই অনলাইন ক্লাস হোক, টিউশন বা ওয়ার্কশপ অনলাইন নির্ভর হোক, স্মার্টফোন ব্যবহারের শিডিউল তৈরী করুন শিশুর জন্য।
৬) খোলা মাঠ, পার্ক, বন্ধুদের সঙ্গে আউটডোর গেমসে উৎসাহ দিন। শিশুর শারীরিক-মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে এর চেয়ে ভাল ওষুধ আর কিছু হয় না।
৭) ফোনের পাসওয়ার্ড শিশুদের সঙ্গে শেয়ার করবেন না।
8) একসঙ্গে খেতে বসে ফোন ব্যবহারের অনুমতি দেবেন না।
৯) রাতে ঘুমতে যাওয়ার সময় ফোন যেন দূরে থাকে।
১০) শিশুর সঙ্গে কথা বলুন। জানুন তার মনের কথা। বন্ধু হয়ে উঠুন।
তবে সবচেয়ে আগে জরুরি নিজে কে শোধরানো। বাবামা-অভিভাবকরা নিজেরাই যদি মোবাইলবন্দী হয়ে থাকে তাহলে সন্তানও সেই পথেই চলবে। নিজের জীবনেও অপ্রয়োজনে মোবাইলের ব্যবহার কমান তবেই ঠিক পথে চলবে শিশু।