শিয়ালদা যখন রণাঙ্গন

পৃথিবীর ব্যস্ততম রেলস্টেশনের নাম জানেন? হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন কলকাতার শিয়ালদহ বা শিয়ালদা স্টেশন, তবে জানেন কি এই শিয়ালদাতেই  হয়েছিল এক ধুন্ধুমার যুদ্ধ? জানেন না? দাঁড়ান বলছি বলছি, ইংরেজরা যখন কলকাতার দখল নিয়েছে এ হলো সেই সময়ের কথা। ১৭৫৬, মারা গিয়েছেন সুবে বাংলার নবাব আলিবর্দী খাঁ, মসনদে বসেছেন নতুন নবাব, আলিবর্দীর দৌহিত্র সিরাজদৌল্লাহ। আলিবর্দীর শাসনকালে ইংরেজদের সঙ্গে আলিবর্দীর নানান কারণে বিরোধ ঘটে এবং আলিবর্দী অপমানিতও বোধ করেন, সেই কারণেই সিরাজ নিজের শাসনের শুরুর দিক থেকেই ইংরেজদের ওপর বেদম চটে ছিলেন।

       শিয়ালদার খুব কাছেই যে কাশিমবাজার রাজবাড়ী, সেখানেই ছিল কাশিমবাজার কুঠি, যা ছিল ইংরেজদের দখলে। সিরাজ প্রথমেই ইংরেজদের  জব্দ করার জন্য কাশিমবাজার কুঠি লুঠ করেন। এরপর সিরাজ ভাবলেন কলকাতা আক্রমণ করবেন, যেমন ভাবা তেমন কাজ উদ্যোগ নিতে থাকলেন কলকাতা আক্রমণ করার। এদিকে ইংরেজরা খবর পেয়েছে সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করবে, নবাব এর সৈন্য আটকানোর জন্য কলকাতার তিনটে জায়গায় কামান বাহিনী কে প্রতিরোধ করতে বলেন ইংরেজরা, প্রথম কামান বাহিনী ছিল রসগোল্লার পীঠস্থানে, হ্যাঁ বাগবাজারে, বাগবাজারের পেরিন্স পয়েন্টেই প্রথম ইংরেজদের সাথে নবাবের সৈন্যের সংঘর্ষ হয়, কিন্তু ব্যর্থ হয় ইংরেজরা। নবাব বাহিনী এগিয়ে চলে কলকাতা দুর্গের দিকে। তারা এগোতে এগোতে রাস্তার দুধারের সমস্ত বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, ধ্বংস হয় বড়বাজার। কলকাতাকে তিনদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে নবাবের সেনাবাহিনী, আক্রান্ত ইংরেজরা ভয় পেয়ে ভাগীরথীর জলপথে ফলতায় পালিয়ে যায়। নবাব সিরাজদৌল্লাহ কলকাতা দখল করলেন। কলকাতার নাম রাখলেন আলিনগর। শাসক হিসেবে নিযুক্ত হলেন মানিকচাঁদ। এই ঘটনার পর কেটে গেলো চারমাস, ব্রিটিশরা খানিকটা গুছিয়ে নিলো নিজেদের, অক্টবর মাসে ফের ক্লাইভের নেতৃত্বে কলকাতায় ফিরে এলো ইংরেজেরা। ১৭৫৭এ ফের ফোর্ট উইলিয়ামে উড়লো ব্রিটিশ পতাকা।

     সিরাজ আবার কলকাতা আক্রমণ করলেন, হুগলি নদী পেরিয়ে কলকাতায় এসে উঠলো সেনাবাহিনী, তারপর দমদমের দিক থেকে আস্তে আস্তে অগ্রসর হতে থাকলো মূল শহরের দিকে। আজকের আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড ঠিক যেখানে তখন সেখানেই ছিল মারাঠা ডিচ বা মারাঠা খাল, আর তার পাশেই ছিল ধনী ব্যবসায়ী গোবিন্দরাম মিত্র আর উমিচাঁদ এর বাগানবাটী। নবাবের সেনাবাহিনী সেখানেই আশ্রয় নিলেন মারাঠা খালের পশ্চিম দিকে, আর নবাব আশ্রয় নিলেন উমিচাঁদের বাগানবাটীতে। প্রথমবার নবাব আক্রমণ করেছিলেন চিৎপুর দিয়ে তাই ক্লাইভ সেখানে আগেই পরীক্ষা খনন করে একটি কামানবাহিনী সাজিয়ে রেখেছিলেন, ক্লাইভের এই পরিকল্পনা জেনে চিৎপুরের রাস্তা ছেড়ে নবাব দমদমের রাস্তা ধরলেন, ক্লাইভও সেই খবর পেয়ে কাশিপুর শিবির থেকে বেরিয়ে পড়লেন নবাবকে আক্রমণের উদ্যেশ্যে,নবাবের সৈন্যকে অতর্কিতে আক্রমণ করবেন আর ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে উমিচাঁদের আশ্রয়ে থাকা সিরাজের মূল শিবিরে আক্রমণ করবেন এমনটাই ভেবে রেখেছিলেন ক্লাইভ, কিন্তু উমিচাঁদের বাগানবাটী পেরোবার পথে যে খাত আছে তার ওপরেই যে সিরাজের কামানবাহিনী অপেক্ষা করছে ঘন কুয়াশায় তা খেয়াল করেননি ক্লাইভ। ক্লাইভের বাহিনী খাত পেরোনোর সেতু অতিক্রম করতে গেলেই আক্রমণ করে সিরাজের কামান বাহিনী,  ক্লাইভ তখন বৌবাজারের দিক দিয়ে আর একটি সেতু পেরিয়ে নবাবের নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু সেখানেও সিরাজের বাহিনী তাকে প্রতিহত করে। শিয়ালদার কাছেই নবাবের বাহিনীর সঙ্গে চূড়ান্ত সংঘর্ষ হয় ক্লাইভের বাহিনীর, ক্লাইভ ও তার দলবল বীরত্বের সঙ্গে  লড়াই করে পর্যদুস্ত করে দেয় নবাবের বাহিনী কে, তাদের একটি কামানও দখল করে নেয়, নবাবের বাহিনী পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়, আর বাংলা বিহার ওড়িষ্যার নবাব সিরাজদৌল্লাহ আশ্রয নেন নাগেরবাজারে। আজকের শিয়ালদহ অঞ্চল দিয়ে যাতায়াতের সময়ে বা তাড়াহুড়ো করে ট্রেন ধরতে যাওয়ার সময় আমরা কি ভাবতে পারি এখানেই এইরকম একটা রোমহর্ষক লড়াই হয়েছিল?  অবাক করা ব্যাপার তাই নয় কি?

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...