মেয়েটা তখন তিন-সাড়ে তিন বছরের। ওইটুকু ক্ষুদে হলে কী হবে, নাচ করতে দারুণ ভালোবাসে সে। যে কোনও নাচ একবার দেখলেই হল। সঙ্গে সঙ্গে হুবহু তুলে নেবে। মেয়েটির মা তামিল চলচ্চিত্রের একজন বেশ নামী অভিনেত্রী এবং নৃত্যশিল্পীও।
মেয়ের নাচের প্রতি আকর্ষণ দেখে একেবারে ছোট্ট থেকেই নাচের তালিম দিতে শুরু করলেন। ফল মিলল হাতে হাতে। মেয়ের যখন সাড়ে চার বছর বয়স তখনই সে ভারতনাট্যমে এমন পারদর্শী যে ১৯৪০ সালে ভ্যাটিকান সিটিতে (রোম) ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য পরিবেশন করার জন্য তাকে মনোনীত করা হলো। তার নাচ মুগ্ধ করেছিল স্বয়ং পোপকে।
মেয়েটি যে শুধু ভারতনাট্যমে পারদর্শী তা নয়, তার মা তাকে খুব যত্ন করে শিখিয়েছিলেন ওয়েস্টার্ন ডান্স বা পাশ্চাত্য নৃত্যও। পাশাপাশি জোর কদমে চলেছিল পড়াশোনা। মাদ্রাজের স্যাক্রেড হার্ট স্কুলে পড়ত সেই মেয়েটি। নাচে এবং পড়াশোনায় - দুইয়েই চৌকস হয়ে উঠছিল সে।
মা বসুন্ধরা দেবী চেয়েছিলেন তার মেয়ে তার মতোই অভিনেত্রী হোক। সে সময়ে তামিল চলচ্চিত্রের একজন নামকরা পরিচালক ছিলেন এম. ভি. রামন। বসুন্ধরার মনোবাসনা জানা মাত্র তিনি ঠিক করে ফেললেন যে নতুন একটি ছবি তৈরি করবেন যাতে বসুন্ধরা-কন্যা হবেন নায়িকা। সময়টা ১৯৪৯, তখন সে চোদ্দ বছরে পা দিয়েছে সবে।যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। নির্মাণ করলেন নতুন তামিল ছবি "বাজাঘাই"। ছবি সুপারহিট। ছবির সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে একই গল্প এবং একই নায়িকাকে নিয়ে পরিচালক এম. ভি. রামন ১৯৫১ সালে তৈরি করলেন হিন্দি চলচ্চিত্র "বাহার"। ছবি সুপারডুপার হিট।
নতুন নায়িকার খ্যাতি উল্কার বেগে ছড়িয়ে পড়ল। হিন্দি চলচ্চিত্র জগত পেল এক অসাধারণ নৃত্যশিল্পী অভিনেত্রীকে পরবর্তী আঠারো বছর যে অভিনেত্রী তার নাচ, সৌন্দর্য এবং অভিনয়ের দীপ্তিতে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন দর্শকদের।
জন্ম হয়েছিল এক নতুন নক্ষত্রের – তাঁর নাম বৈজয়ন্তীমালা। এই প্রথম কোনও দক্ষিণী অভিনেত্রী একেবারে তারকা রূপে পা রেখেছিল বলিউডে বা বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। এবং দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যে পথ ধরে পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ ভারত থেকে হিন্দি ছবিতে পা রেখে এবং অভিনয় করে বিখ্যাত হয়েছেন হেমা মালিনী, লেখা, শ্রীদেবী, ঐশ্বর্য রাই এবং অধুনা দীপিকা পাডুকোন।
"বাহার" এর সাফল্যের পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি বৈজন্তীমালাকে। নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থ, পুরস্কার সবই এসেছিল জীবনে। ১৯৫৪তে মুক্তি পেল "নাগিন"। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর, লতা মঙ্গেশকরের ঐ মধুক্ষরা কন্ঠের গান আর বৈজয়ন্তীমালার অপরূপ নৃত্যকলার সমন্বয়; সারা ভারত তো বটেই, ভারতের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল বৈজয়ন্তীমালার জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি। এই ছবির গান এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। হিন্দি চলচ্চিত্রে প্রথম সেমিক্ল্যাসিকাল নাচের প্রচলন করেছিলেন তিনিই। স্বয়ং জহরলাল নেহেরু পর্যন্ত তাঁর নাচের গুনমুগ্ধ ছিলেন।
এরপর একের পর এক হিট বা সুপারহিট হিন্দি সিনেমা, পাশাপাশি চুটিয়ে অভিনয় তামিল ও তেলেগু ফিল্মে। অভিনয় করেছিলেন তপন সিংহের মতো খ্যাতনামা পরিচালকের ছবিতেও। তখনকার সময়ের হিন্দি ছবির সব ক'জন শীর্ষস্থানীয় নায়কদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন বৈজয়ন্তীমালা। তাঁর ডেট পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন বিখ্যাত পরিচালক/প্রযোজকরা। ছবি হিট করানোর এই ক্ষমতার জন্য তাকে বলা হতো "নুমেরো উনো অ্যাকট্রেস" বা "সেরা বর্ণময় অভিনেত্রী"। নাচের পারদর্শীতার জন্য তার নাম দেওয়া হয়েছিল "টুইঙ্কল টোজ"।
এরপর একের পর এক হিট... নয়া দৌর, গঙ্গা যমুনা, নিউ দিল্লি, সঙ্গম, মধুমতী। কাজ করলেন বিমল রায়ের কালজয়ী ছবি "দেবদাস" -এ। এই ছবিতে চন্দ্রমুখীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। তাঁর অভিনয় অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল কিন্তু এই ছবি নিয়েই কিছু বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছিল। চন্দ্রমুখী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বৈজয়ন্তীমালা মনোনীত হয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ সহ-অভিনেত্রীর ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের জন্য।
কিন্তু তিনি সেই পুরস্কার নিতে অস্বীকার করে বলেছিলেন "আমি এই ছবিতে নায়িকার ভূমিকাতেই অভিনয় করেছি সুতরাং সহ-অভিনেত্রীর পুরস্কার আমি নিতে পারব না"। মনে রাখতে হবে সম্পূর্ণ পুরুষতান্ত্রিক সেই সময়ের চলচ্চিত্র দুনিয়ায় এমন প্রতিবাদ করা কিন্তু কম সাহসিকতার কাজ নয়। পুরস্কার অধরা থাকেনি তাঁর। একের পর এক ব্লকবাস্টার উপহার দিয়ে ১৯৫৯-এ সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন তিনি।
দিলীপকুমারের সঙ্গে জুটি বেঁধে সবথেকে বেশি হিট ছবি উপহার দিয়েছেন, এবং বৈজয়ন্তীমালা প্রেমে পড়ে যান দিলীপকুমারের। আরো একজন বিখ্যাত নায়কের সঙ্গেও নাম জড়িয়ে পড়ে তার। তিনি রাজ কাপুর। বৈজয়ন্তীমালা পরবর্তী সময়ে স্বীকারও করেছেন যে তিনি একইসঙ্গে দু'জন নায়ককে ভালবেসেছিলেন। রাজ কাপুর তখন বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক। তাঁর এবং বৈজয়ন্তীমালার সম্পর্কের কারণে রাজের স্ত্রী কৃষ্ণা সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
রাজ কাপুর এবং দিলীপকুমার - দু'জনের কারো সঙ্গেই তার প্রেম পরিণতি লাভ করেনি। ১৯৬৮ সালে বৈজয়ন্তীমালা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন ডাক্তার চমনলাল বালির সঙ্গে। বিয়ের পর চলচ্চিত্রে অভিনয় ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। মনোনিবেশ করেছিলেন শুধু ভরতনাট্যমে। ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যকলায় তাঁর অবদানের জন্য তিনি "ভারতীয় সঙ্গীত নাটক আকাদেমি" পুরস্কার লাভ করেন ১৯৮২ সালে।
অসামান্যা গুণী এই শিল্পী বর্তমানে চেন্নাইবাসিনী। এই ছিয়াশি বছর বয়সেও তিনি ব্যস্ত থাকেন তাঁর নাচ এবং খেলা নিয়ে। বলা হয়নি, বৈজয়ন্তীমালা বালি একজন ভালো গল্ফ খেলোয়াড়ও।
এক সময় অভিনয় আর নাচ দুইয়ের জাদুতেই সম্রাজ্ঞী হয়ে উঠেছিলেন অডিয়েন্সের মনে। ছবির টাইটেল কার্ডে বৈজয়ন্তীমালার নাম মানেই অন্যরকম প্রত্যাশা। এখনও তিনি একইরকম সেনসেশন। সময় আর বয়স দুইকেই শাসন করছেন নিজের শিল্পের মাধুর্যে। সেই নিরিখে নতুন প্রজন্মের কাছেও হয়ে উঠেছেন 'ভালো থাকার' অনুপ্রেরণা...