এখন বিশ্বকাপের মরসুম। ক্রিকেটের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলছে অস্ট্রেলিয়ায়। এই মুহূর্তে বিশ্ব ক্রিকেটে বড় দল গুলির নাম বলতে গেলে অস্ট্রেলিয়া আর ভারত এই দুটো নাম উঠবেই। আর ভারত অস্ট্রেলিয়া খেলার কথা উঠলে প্রথমেই যার নাম মুখে আসে তিনি ভিভিএস লক্ষ্মণ।
একুশটা বছর আগের কথা হলেও আজও চোখের সামনে পুরোটাই উজ্জ্বল। ২০০১ সালের ১৪ মার্চ ক্রিকেট বিশ্ব এক অবিশ্বাস্য জুটির সাক্ষী থেকেছিল। ইডেনে এই দিনেই পুরোটাই ব্যাট করেছিলেন ভিভিএস লক্ষ্মণ এবং রাহুল দ্রাবিড়। সেটা ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের চতুর্থ দিন। তৃতীয় দিনের শেষে লক্ষ্মণ ১০৯ রানে এবং দ্রাবিড় ৭ রানে অপরাজিত ছিলেন। ভারতের রান ছিল ৪ উইকেটে ২৫৪। চতুর্থ দিন পুরোটা ব্যাট করেন লক্ষ্মণ এবং দ্রাবিড়। লক্ষ্মণ ২৭৫ রানে ও দ্রাবিড় ১৫৫ রানে অপরাজিত থাকেন। সারা দিনে যোগ হয় ৩৩৫ রান।
স্টিভ ওয়ার অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ৪৪৫ রান করার পর ভারতের প্রথম ইনিংস মাত্র ১৭১ রানে শেষ হয়ে যায়। ২৭৪ রানে পিছিয়ে ছিল ভারত। যদিও সেই ইনিংসেও ৫৯ রান করেছিলেন লক্ষ্মণ। তাই লক্ষ্মণ ছন্দে থাকায় তাঁকে ফলো অন করা ইনিংসে তিন নম্বরে ব্যাট করতে পাঠানো হয়। বরাবর তিন নম্বরে ব্যাট করা দ্রাবিড়কে ছয় নম্বরে নামানোর সিদ্ধান্ত নেয় টিম ম্যানেজমেন্ট। শেষ ইনিংসে লক্ষ্মণ যখন ব্যাট করতে নামেন তখন ভারতের ১ উইকেটে ৫২ রান। এরপর একে একে ফিরে যান সচিন ও সৌরভ। তবে লক্ষ্মণ দমে যাননি। দ্রাবিড়কে সঙ্গে নিয়ে গড়েন ঐতিহাসিক জুটি। পঞ্চম উইকেটে ৩৭৬ রান যোগ করেন দুজন। লক্ষ্মণ থামেন ২৮১ রানে। দ্রাবিড় ফেরেন ১৮০ রানে। বাকিটা ইতিহাস। দুই ব্যাটসম্যানের লড়াকু ইনিংসের পাশাপাশি হরভজন সিংহও ছিলেন দারুণ ছন্দে। প্রথম ইনিংসে হ্যাটট্রিক করেন ভাজ্জি। দ্বিতীয় ইনিংসেও নেন ৭৩ রানে ৬ উইকেট। ফলে ১৭১ রানে সেই টেস্ট জিতে সিরিজে সমতা ফেরায় ভারত।
লক্ষ্মণ ও দ্রাবিড়ের সেই জুটির জন্যই শুধু ইডেন টেস্ট নয়, চেন্নাই টেস্টে জিতে সিরিজও পকেটে পুরেছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভারতীয় দল। একই সঙ্গে হায়দরাবাদির সেই ইনিংস নাকি ভারতীয় ক্রিকেটের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এমনটাই মনে করেন সৌরভ।
সেই টেস্টের প্রসঙ্গ উঠলেই অজি অধিনায়ক স্টিভ ওয়া এখনও আফসোস করেন। বলেন, “টেস্টে ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম দাপুটে ইনিংস। একজন ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে বারবার এমন ইনিংস দেখতে ইচ্ছে করে। এমন ইনিংস দেখার জন্য অনেক মাইল হেঁটে যাওয়া যায়। কিন্তু বিপক্ষ দলের অধিনায়ক হিসেবে এমন ইনিংস দেখা খুবই যন্ত্রণার। সেই যন্ত্রণা এখনও আমাকে কষ্ট দেয়। চতুর্থ দিন বল লাট্টুর মত ঘুরলেও শেন ওয়ার্নকে অনায়াসে খেলেছিল লক্ষ্মণ। এমনকি বাকিদেরও দুজন অনায়াসে খেলে দেয়। ফলে আমার পক্ষে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।”
একটা সময় ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের ফ্যাভ ফাইভ নিয়ে আলোচনা করলেই তাঁর নাম চলে আসত। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন টিম ইন্ডিয়ার ব্যাটিং বিভাগের অন্যতম মহীরুহ ছিলেন তিনি। কিন্তু কেরিয়ারে শুধুমাত্র টেস্ট স্পেশালিস্ট তকমা চলে আসার পরে ওয়ান ডে ফরম্যাটে সেভাবে আর সুযোগ পাননি।
টেস্ট ইডেনে হোক বা মোহালি, বরাবরই অজিদের বিরুদ্ধে ভারতকে একাধিক ম্যাচ জিতিয়েছেন লক্ষ্মণ। টেস্ট বিশেষজ্ঞ হিসাবেই ভারতীয় কিংবদন্তির সুখ্যাতি। তিনি একটিও ওয়ান ডে বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে মাঠে নামেননি। তবে ওয়ান ডে’তে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেও লক্ষ্মণের রেকর্ড কিন্তু ঈর্ষণীয়।
লক্ষ্মণ ভারতের হয়ে মাত্র ৮৬টি ওয়ান ডে ম্যাচ খেলেছিলেন। তাঁর গড় এমন কিছু আহামরি নয়। ৮৩টি ইনিংসে ৩০.৭৬ গড়ে মোট ২৩৩৮ রান করেছেন তিনি। ৫০ ওভারের ফর্ম্যাটে শতরান করেছেন ছয়টি। এই ছয় ওয়ান ডে শতরানের মধ্যে অজিদের বিরুদ্ধে তিনি চারটি শতরান করেন। তবে ২০০৪ সালে পাকিস্তান সফরে পঞ্চম ওয়ান ডে ম্যাচটি ভিভিএস লক্ষ্মণ তাঁর কেরিয়ারের অন্যতম সেরা একটি ম্যাচ হিসেবেই দেখবেন।
কিন্তু একটিও বিশ্বকাপে খেলেননি তিনি, এটাই ভিভিএস লক্ষ্মণের জীবনে সব চেয়ে বড় আফসোস। ২০০৩ বিশ্বকাপের দলে তাঁকে না দেখে দেশের ক্রিকেট মহলে অনেকে অবাক হয়েছিলেন। আর লক্ষ্মণ এতটাই হতাশ হয়েছিলেন যে, ক্রিকেট ছাড়ার কথাও ভেবে ফেলেছিলেন। একবার কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে এসে নিজেই সে কথা শোনান লক্ষ্মণ। সেই অনুষ্ঠানেই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্বীকারোক্তি, ইডেনে লক্ষ্মণের ২৮১ রানের ঐতিহাসিক ইনিংস তাঁর নেতৃত্ব বাঁচিয়ে দিয়েছিল। ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে লক্ষ্মণ সেই টেস্ট না জেতালে তাঁর নেতৃত্বই থাকত না বলে মনে করেন সৌরভ।
২০০৩ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেই বিশ্বকাপে লক্ষ্মণের জায়গায় দীনেশ মোঙ্গিয়াকে দলে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু লক্ষ্মণ সেই সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি। সেই ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘ওটা ছিল আমার জীবনের সব চেয়ে খারাপ সময়। এতটাই ভেঙে পড়েছিলাম যে, নিজেকে ক্রিকেট থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে চলে গিয়েছিলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে। ক্রিকেট ভুলে থাকার জন্য।’’ সে সময় ক্রিকেট ছাড়ার ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘তখন ভেবেইছিলাম ক্রিকেট ছেড়ে দেব। মনের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বাবা-মা আমাকে অনেক বুঝিয়ে ক্রিকেটে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।’’
মার্চে ভারত বিশ্বকাপ ফাইনালে হেরে যাওয়ার পরে লক্ষ্মণ ওয়ান ডে দলে ফিরে আসেন অক্টোবরে। ফিরে এসে দ্বিতীয় ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১০২ রান করেন তিনি। পরের বছর জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে তিনটি ওয়ান ডে সেঞ্চুরিও করেন। ‘‘নিজেকে ক্রিকেটে ফিরিয়ে আনতে ওই পাঁচ মাস আমার যা গিয়েছিল, তা আমিই জানি। ওই সময় বাবা-মা দু’জনেই আমাকে না বোঝালে হয়তো তখনই ক্রিকেটজীবন শেষ করে দিতাম।’’
সেই সময়ে ভারতীয় অধিনায়ক ছিলেন সৌরভ। লক্ষ্মণের ওয়ান ডে দলে যে বেশি সুযোগ দেওয়া হয়নি, তা স্বীকার করে নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘লক্ষ্মণ যে কোনও ধরনের ক্রিকেটেই ভাল খেলার মতো ব্যাটসম্যান। ওকে ওয়ান ডে দলে না নেওয়াটা হয়তো আমার ভুলই ছিল। আসলে ক্যাপ্টেনদের সব সিদ্ধান্ত বোধ হয় ঠিক হয় না।’’ তবে ইডেনের সেই ২৮১ যে তাঁর অধিনায়কত্ব বাঁচিয়েছিল, তা এ দিন স্বীকার করে নিয়ে সৌরভ বলেন, ‘‘লক্ষ্মণ সে দিন ওই ইনিংস না খেললে আমরাও জিততে পারতাম না আর আমাকেও নেতৃত্ব হারাতে হত।’’ সেই দলের সদস্য জাহির খানও এই অনুষ্ঠানে ছিলেন। তিনি ও সৌরভ দু’জনেই একমত যে, তাঁদের ও সচিন, সহবাগ, যুবরাজ হরভজনদের সেই স্বর্ণযুগের দলের সব চেয়ে ভদ্র সদস্যটি ছিলেন লক্ষ্মণই।
একসময় ভারতের ক্রিকেট দলের কোচ হয়ে আসেন গ্রেগ চ্যাপেল। শুধু সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নন, গ্রেগ চ্যাপেলের রোষের নাকি মুখে পড়েছিলেন ভি ভি এস লক্ষ্মণও। কিছুদিন আগে ২০০৫ সালে জিম্বাবোয় সফরের একটি ঘটনার কথা মনে করালেন ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার সঞ্জয় মঞ্জরেকর।
সে বছর হারারেতে একটা টেস্ট ম্যাচ চলার সময় আঙুলে চোট পান লক্ষ্মণ। শুশ্রূষার জন্য মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। তাঁর পরিবর্তে যে ক্রিকেটার মাঠে নেমেছিলেন তিনি ক্যাচ ফস্কান। তাতেই রেগে যান চ্যাপেল। মঞ্জরেকর বলেন, “হারেরেতে টেস্ট ম্যাচ চলার সময় প্রথম একাদশে না থাকা ক্রিকেটারদের নিয়ে অনুশীলন করছিলেন চ্যাপেল। ৩০-৪০ মিনিট পর সাজঘরে ফিরেছিলেন তিনি। সেই সময় তিনি দেখেন ম্যাচে এক পরিবর্ত ক্রিকেটার স্লিপে ক্যাচ ফস্কেছে। তিনি চিন্তা করতে থাকেন কার বদলে মাঠে এই পরিবর্ত ক্রিকেটার। সাজঘরে ফিরে দেখেন লক্ষ্মণ কফি খাচ্ছে। রেগে গিয়ে লক্ষ্মণকে জিজ্ঞেস করেন সে মাঠে নেই কেন। লক্ষ্মণ বলে চোট পেয়েছে সে, বরফ লাগানোর জন্য বাইরে এসেছে।”
মঞ্জরেকর বলেন, “চ্যাপেল জিজ্ঞেস করেন, ‘সেটা কি তোমায় মেরে ফেলতে পারতো?’ লক্ষ্মণ অবাক হয়ে যায়। চ্যাপেল বলেন, ‘জীবন সংশয় না হলে একদম মাঠ ছাড়বে না।” লক্ষ্মণের মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসা চ্যাপেল ভাল চোখে নিতে পারেননি। পরিবর্ত ক্রিকেটার নামা ক্রিকেটে খুবই সাধারণ ঘটনা। সেই ঘটনা নিয়ে লক্ষ্মণের মতো সিনিয়র ক্রিকেটারকে এ ভাবে বলা ঠিক মনে হয়নি মঞ্জরেকরেরও।
আত্মজীবনী '২৮১ অ্যান্ড বিয়ন্ড'-এ ভিভিএস লক্ষ্মণ চ্যাপেলকে অনমনীয় ও বাঁধা-ধরা মানসিকতার অধিকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। লিখেছেন, আন্তর্জাতিক দল কী ভাবে চালাতে হয়, তার কোনও ধারণাই ছিল না গ্রেগের।
লক্ষ্মণের মতে, ভারতীয় দলকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিলেন গ্রেগ। জন্ম নিয়েছিল বিশ্বাসের অভাবও। লক্ষ্মণ লিখেছেন, "কোচের যাঁরা পছন্দের, তাঁদের দিকে খেয়াল রাখা হত সবসময়। বাকিদের নিজেদের খেয়াল নিজেকেই রাখতে হত। চোখের সামনে ভারতীয় দলে কয়েকটা ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।"
গ্রেগ প্রসঙ্গে আত্মজীবনীতে লক্ষ্মণ লিখেছেন, "গ্রেগের পুরো সময়টাই ছিল তিক্ততায় ভরা। মানসিকতার দিক দিয়ে অনমনীয় ও বাঁধা-ধরা ছিলেন উনি। কী ভাবে দল চালাতে হয়, তা জানতেন না। উনি ভুলে যেতেন যে খেলোয়াড়রাই মাঠে নেমে খেলে আর ওরাই তারকা, কোচ তারকা হতে পারে না।"
২০০৫ সালের মে মাস থেকে ২০০৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ভারতের জাতীয় দলের কোচ ছিলেন গ্রেগ। লক্ষ্মণ লিখেছেন, "ভারতে এসে গ্রেগ সব রকমের সহায়তা পেয়েছিলেন। কিন্তু যখন ছাড়লেন, তখন ভারতীয় দল ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে। আমার ক্রিকেট কেরিয়ারে সবচেয়ে খারাপ সময়ের নেপথ্যে বড় ভূমিকা ছিল ওর। ফলাফল হয়তো দেখায় যে চ্যাপেলের আমলে ভারতীয় দল সাফল্য পেয়েছে, কিন্তু ওই ফলাফলের সঙ্গে কোচের কোনও সম্পর্ক নেই। ব্যাটসম্যান গ্রেগ চ্যাপেলের প্রতি আমার শ্রদ্ধা থাকবে চিরকাল। কিন্তু, তা কোচ গ্রেগ চ্যাপেলের ক্ষেত্রে বলতে পারছি না।"
বাবা শান্তারাম এবং মা সত্যভামা দু’জনেই নামী চিকিৎসক। তিনি নিজেও ডাক্তারি পড়তে শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ অবধি পা রাখেন বাইশ গজে। ভারত পায় ভিভিএস লক্ষ্মণের মতো ক্রিকেটার। প্রতিভাবান হয়েও যিনি রয়ে গিয়েছিলেন মেঘে ঢাকা তারা হয়ে। তবে লক্ষ্মণের ক্রিকেটীয় কেরিয়ারের প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি প্রভাব ফেলেনি দাম্পত্য জীবনে। তাঁর সহযোদ্ধাদের অর্ধাঙ্গিনীদের মতো লক্ষ্মণের স্ত্রী শৈলজা খুব বেশি প্রচারমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে আসেননি। তাঁদের প্রেমপর্বও রয়ে গিয়েছে অপেক্ষাকৃত অনালোচিত আখ্যান হয়েই।
বিয়ের আগে লক্ষ্মণ-শৈলজা রঙিন প্রেমপর্ব বিশেষ নেই। ছেলের জন্য পাত্রী পছন্দ করেছিলেন লক্ষ্মণের মা। চিকিৎসক সত্যভামার মনে হয়েছিল সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রী জি আর শৈলজাই তাঁর ছেলের যোগ্য সহধর্মিণী হবেন। ২০০৪ সালে শৈলজাকে বিয়ে করেন লক্ষ্মণ। তাঁদের মেয়ের নাম অচিন্ত্যা এবং ছেলের নাম তাঁরা রেখেছেন সর্বজিৎ। লক্ষ্মণ এবং শৈলজার সফল দাম্পত্য প্রমাণ করেছে, সত্যভামার অনুমান নির্ভুল ছিল। তাঁর ছেলের যোগ্য জীবনসঙ্গী হতে পেরেছেন শৈলজা। ক্রিকেট কেরিয়ারের নানা ওঠাপড়ায় তিনিই ছিলেন স্বামীর মানসিক শক্তির অন্যতম উৎস।
তবে লক্ষ্মণ যে ভবিষ্যতে ক্রিকেটার হবেন, সে বিষয় নিশ্চিত ছিল না তাঁর তারুণ্যেও। পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রিকেট চলছিল অনেক দিন। কিন্তু শেষ অবধি ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন মুলতুবি রেখে লক্ষ্মণ চলে আসেন খেলার মাঠে। ১৯৯২-৯৩ মরশুমে রঞ্জি ট্রফি দিয়ে তাঁর ঘরোয়া ক্রিকেটে যাত্রা শুরু। প্রথম ইনিংসে শূন্য রান করেন। তার পরের সুযোগগুলোয় অবশ্য আর খালি হাতে ফিরে আসতে হয়নি তাঁকে। ঘরোয়া ক্রিকেটে দুরন্ত পারফরম্যান্স তাঁর জন্য জাতীয় দলের দরজা খুলে দেয় ১৯৯৬ সালে। সে বছর নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তাঁর টেস্ট অভিষেক। ওয়ান ডে ম্যাচে আত্মপ্রকাশ ২ বছর পরে। জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে। তবে ওয়ান ডে ম্যাচের তুলনায় তিনি অনেক বেশি সফল টেস্টে। টেস্টের বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান হিসেবে ধরা হয় তাঁকে। দীর্ঘ দেড় দশক পেরিয়ে যাওয়া কেরিয়ারে ১৩৪ টেস্টে তিনি সংগ্রহ করেছেন মোট ৮৭৮১ রান সর্বোচ্চ ২৮১, গড় ৪৫.৫।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি থাকাকালীন এক টেলিভিশন চ্যানেলে সৌরভ বলেন, ‘‘ভারতীয় দলের হয়ে কাজ করার জন্য ও লক্ষ্মণ মুখিয়ে ছিল। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। কিন্তু আগামী দিনে ও ভারতীয় দলের কোচ হওয়ার সুযোগ পাবে।’’
অক্টোবরের শুরুতেই ভারতীয় দলের সাজঘরে আবার দেখা গেল ভিভিএস লক্ষ্মণকে। কোচ হিসাবে সুযোগ এলো ভরতের মাটিতে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে কোচ করা হয় তাঁকে। ২২ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। সেই কারণে আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে রোহিত শর্মা, লোকেশ রাহুল, বিরাট কোহলী-সহ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দলকে আগেই অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে এক দিনের সিরিজে খেলেনি তাঁরা। রোহিতদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দেওয়া হয় জাতীয় দলের কোচ রাহুল দ্রাবিড়কেও। সেই কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে দায়িত্ব দেওয়া হয় লক্ষ্মণকে।
এর আগে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধেও ভারতীয় দলের কোচ হয়েছিলেন লক্ষ্মণ। জিম্বাবোয়েতে লোকেশ রাহুলের দলের কোচও ছিলেন তিনি। এশিয়া কাপের আগে দ্রাবিড়ের করোনা হয়। সেই সময় দলের কোচ হিসাবে নিয়ে যাওয়া হয় লক্ষ্মণকে। পাকিস্তান ম্যাচের আগে দ্রাবিড় দলে যোগ দিলে দায়িত্ব ছাড়েন ভারতের প্রাক্তন ব্যাটার। এখন ভারত ‘এ’ দলের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন লক্ষ্মণ।
লক্ষ্মণের কোচিংয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে এক দিনের সিরিজে জয় পায় ভারত। লখনউয়ে প্রথম ম্যাচের আগে লক্ষ্মণ বলেছিলেন, ‘‘আমাদের রিজ়ার্ভ বেঞ্চ খুব শক্তিশালী। প্রত্যেকে নজর কাড়ার চেষ্টা করছে। সবাই নিজের সেরাটা দিচ্ছে। বিশেষ করে ব্যাটিং অর্ডারে একের পর এক দুর্দান্ত ব্যাটার রয়েছে। কাকে বাদ দিয়ে কাকে খেলাব, সেটা ঠিক করা কঠিন কাজ। ২০২৩ সালের বিশ্বকাপের দল নির্বাচন করতে গিয়ে নির্বাচকরা সমস্যায় পড়বেন।’’
লক্ষ্মণের মতে, এক দিনের বিশ্বকাপের আগে নির্বাচকদের নজরে পড়ার সুযোগ রয়েছে শুভমন গিল, ঈশান কিশনদের কাছে। এই সুযোগ বার বার আসবে না বলেই মনে করেন তিনি। লক্ষ্মণ বলেন, ‘‘এখন প্রথম দলের ক্রিকেটাররা নেই। তাই বাকিদের কাছে সুযোগ রয়েছে ভাল খেলার। এই সুযোগ কিন্তু বার বার আসবে না। সেটা এই ক্রিকেটাররা ভাল করেই জানে।’’
দ্রাবিড়ের অবর্তমানে দায়িত্ব নিলেও তিনি শুধুই ভারতীয় কোচকে সাহায্য করার চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন লক্ষ্মণ। তিনি বলেন, ‘‘আয়ারল্যান্ড সিরিজ় থেকে দায়িত্ব নেওয়া শুরু করেছি। দ্রাবিড় ভারতীয় দল নিয়ে এত ব্যস্ত যে ওকে সাহায্য করা প্রয়োজন। সেই কাজটাই করছি। এখনও পর্যন্ত এই দায়িত্ব বেশ ভাল লাগছে।’’
বর্তমানে জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে (এনসিএ) প্রধান ভিভিএস লক্ষ্মণ। জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার আগে এনসিএ-র দায়িত্বে ছিলেন দ্রাবিড়। মহিলা ক্রিকেটের ব্যাপারেও ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার ভিভিএস লক্ষ্মণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আগামী বছর থেকে শুরু হচ্ছে মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। মহিলা ক্রিকেটার তুলে আনার ব্যাপারে লক্ষ্মণের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
অনেকেই বলছেন, ভারতীয় ক্রিকেটের এখন যা অবস্থা তাতে তিনটি দল গড়ে ফেলা যাবে, যারা যেকোনও আন্তর্জাতিক দলের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। এতটাই শক্তিশালী ভারতীয় দলের রিজার্ভ বেঞ্চ। কিন্তু এতে খুশি নন ভিভিএস লক্ষ্মণ। তাঁর মতে, ভারতীয় ক্রিকেটকে পরের ধাপে নিয়ে যেতে গেলে শুধু ক্রিকেটারদের রিজার্ভ বেঞ্চ তৈরি করলে হবে না, বিশ্ব মানের কোচ এবং সাপোর্ট স্টাফদের রিজার্ভ বেঞ্চও তৈরি করে ফেলতে হবে।
গত ডিসেম্বরে জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির (এনসিএ) প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেন লক্ষ্মণ। কিছুদিন আগে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের অ্যাপেক্স কাউন্সিলের এক বৈঠকের পর তিনি বলেন, ‘‘আমি খুব বেশি দিন হল দায়িত্বে আসিনি। এটুকু বলতে পারি, আমার লক্ষ্য শুধু ক্রিকেটারদের দিকে নয়। ক্রিকেটারদের শক্তিশালী রিজার্ভ বেঞ্চ যেমন দরকার, মনে করি কোচ এবং সহকারীদের জন্যও রিজার্ভ বেঞ্চ তৈরি করা দরকার। এখন ক্রিকেট যে পেশাদারিত্বে পৌঁছেছে এবং যে পরিমাণ খেলা হচ্ছে, তাতে যোগ্য কোচ, ফিজিয়ো, ক্রীড়াবি়জ্ঞানীদের চাহিদা বাড়তে বাধ্য। আমাদের দেশে যথেষ্ট প্রতিভা আছে। তারা যাতে নিজেদের মেলে ধরতে পারে, তার জন্য মঞ্চ তৈরি করাটা আমার দায়িত্ব।’’
এরপর লক্ষ্মণ জোর দেন, রাজ্য সংস্থাগুলির সঙ্গে সমন্বয়ের উপর। বলেন, ‘‘রাজ্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আরও বাড়াতে হবে। এনসিএ এবং রাজ্য সংস্থাগুলোর যোগাযোগ না বাড়ালে ক্রিকেটারদের চোট সমস্যা কমানো যাবে না। আমাদের সবার লক্ষ্য একটাই, ক্রিকেটারদের সেরা সুবিধেটা দেওয়া। তার জন্য যেটা করার, আমরা সেটাই করব।’’
নিবন্ধকারঃ ঋদ্ধি রিত