বোলার যখন ভিভ

বোলারদের কীভাবে ভোগাতেন সেটা নিয়ে তো কিছু বলার বাকি নেই। কিন্তু ব‍্যাটসম‍্যানদেরও স্বস্তি দেননি বোলারের ভূমিকায়। টেস্টে বোলার হিসেবে বিরাট সাফল‍্য না থাকলেও(তেমন দরকারও হয়নি)ওয়ান ডে'তে শতাধিক উইকেটের মালিক ভিভ রিচার্ডস। কেরিয়ারের শুরুতে রবার্টস-হোল্ডিং আর কেরিয়ারের পরবর্তী পর্যায়ে মার্শাল-ওয়ালশ-অ্যাম্ব্রোজ-বিশপদের গতির মধ‍্যে তাঁর ঘূর্ণিও ম‍্যাচ জিতিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। নেহরু কাপে ভারতের বিরুদ্ধে ৬টা উইকেট নিয়ে নাকাল ক'রে ছেড়েছিলেন। আরও কয়েকটি ওয়ান ডে'তে ভারতকে বেগ দিয়েছেন বোলার ভিভ। স্পিন খেলায় দক্ষ ভারতীয়দের বিরুদ্ধে এমন কৃতিত্ব বোলার হিসেবে তাঁর জাত চেনাতে যথেষ্ট। নিউজিল‍্যান্ডের বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ সেঞ্চুরির সঙ্গে ৫টা উইকেটও তুলে নেন।

ওয়ান ডে'র ইতিহাসে এ ব‍্যাপারে তিনিই প্রথম। বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ৩ উইকেট নিয়ে ম‍্যাচ জেতান। নেহরু কাপের উত্তেজক ফাইনালে শেষ ওভারে নিজেই বল হাতে নেন। চতুর্থ বল পর্যন্ত ইমরানদের আটকেও রেখেছিলেন।পঞ্চম বলে আক্রাম ছয় মেরে জিতিয়ে দেন পাকিস্তানকে।ওয়ান ডে'তে স্পিনারদের গুরুত্ব প্রমাণে আব্দুল কাদির-শিবরামাকৃষ্ণণ-রবি শাস্ত্রীদের পাশাপাশি ভিভের অবদানও কম নয়। Viv Richards - The Man. ক্রিকেট ইতিহাসে একজনকেই কিং বলা হয় আর তিনি হলেন স্যার ভিভ রিচার্ডস। 

viv

ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে আইকনিক দৃশ্যগুলোর অন্যতম একটা দৃশ্য হল স্যার ভিভ রিচার্ডসের ব্যাট হাতে মাঠে আগমন। চুইংগাম চিবোতে চিবোতে শান্ত চোখে উইকেটে আসতেন তিনি। আর খুনে দৃষ্টিতে বোলারকে দেখে নিয়ে নিজের ব্যাটিং শুরু করতেন। ১৯৭৪ সালে ভারতের চিন্নস্বামী স্টেডিয়ামে টেস্টে অভিষেক হয় ২২ বছরের এক তরুণের। এরপর নিজের ভয়ংকর ব্যাটিং দিয়ে সারাবিশ্বের ক্রিকেট ভক্তদের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন স্যার ভিভ রিচার্ডস। প্রায় ১৮ বছরের ক্যারিয়ারে ১২১ টেস্টে করেছেন ৮৫৪০ রান। গড় ৫০.২৩। স্ট্রাইক রেট ৬৯.২৮।

ওয়ানডে অভিষেক হয়েছিল এক বছর পরে। ১৮৭ ওয়ানডে ম্যাচে ৪৭ গড়ে করেছেন ৬৭২১ রান, ৯০.২ স্ট্রাইক রেটে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলেছেন ৫০৭টি ম্যাচ। অবিশ্বাস্যভাবে ১১৪টি সেঞ্চুরি তার নামের পাশে। রান করেছেন ৩৬ হাজার ২১২। লিস্ট-এ তে ৫০০ ম্যাচে করেছেন প্রায় ১৭ হাজার রান (১৬,৯৯৫) ভিভ রিচার্ডস হলেন টেস্ট ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান যিনি ১৫০ এর বেশি স্ট্রাইক রেটে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। ১৯৮৫ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যান্টিগায় ক্যারিয়ারের ২০তম সেঞ্চুরিটি তিনি তুলে নিয়েছিলেন মাত্র ৫৬ বলে! তাঁর পুরো নাম স্যার আইজ্যাক ভিভিয়ান আলেক্সান্ডার রিচার্ডস। মাঠে শুধু তাঁর উপস্থিতিই প্রতিপক্ষের শিরদাঁড়ায় ভয়ের শীতল স্রোত বইয়ে দিত।

viv ball

আমরা যদি ক্রিকেটের সব ধরনের ব্যাকরণ বই এবং পরিসংখ্যানের ঝাঁপি নিয়ে বসি তবুও ক্রিকেটের দীর্ঘ ইতিহাসে ভিভের চেয়ে ভাল ব্যাটসম্যান খুব একটা পাওয়া যাবে না। তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে ব্যাট হাতে ভিভকে নামতে দেখে প্রতিপক্ষের স্নায়ুতে যে চাপ পড়ত, সেরকম ব্যাটসম্যান ক্রিকেটে দ্বিতীয়টি এখনও আসেনি!

তিনি যখন প্যাভিলিয়ন থেকে হাঁটা শুরু করতেন তখন থেকেই মাঠে উপস্থিত প্রতিটি চোখ তাঁকে অনুসরণ করত। প্রথম দিকে তিনি ৩/৪ পজিশনে ব্যাট করলেও পরের দিকে সাধারণত ৫ বা ৬ নম্বরে ব্যাট করতেন। পূর্ববর্তী ব্যাটসম্যান আউট হবার পর মাঠ জুড়ে প্রায় শুনশান নীরবতা নেমে আসত। অনেকটা ঝড়ের আগের পূর্বাভাস! বিদ্ধস্ত ঝড়ের আর এক নাম ভিভ। ৮২-৮৩ এর আফ্রিকান নীল আকাশে যখন বর্ণবাদীত্বের কালো মেঘ চড়াও হয়েছে, প্রলোভন-চপলার আশঙ্কা সরিয়ে মানুষটা অনায়াসেই ব্ল্যাঙ্কচেক ছুঁড়ে দিলেন আলি বাখারের মুখের দিকে। ঠিক ততটাই অনায়াসে, যতটা অনায়াসে পুরো হেলমেট ছাড়াই বোথাম-লিলি দের গতিময় বাউন্সারগুলো নির্ভীকতায় সামলে নেওয়া যায়। যতটা অনায়াসে স্কুপ, পুল, অ্যাক্রস ব্যাটে ১৫০০০ এর স্তূপ গড়ে তোলা যায়। 

ঠিক যতটা অনায়াসে স্বপ্রতিভ হয়ে উঠলে মোনাকো তে এসে নেলসন ম্যান্ডেলা করমর্দন করে বলে উঠতে পারেন 'I am glad you didn't tour apartheid South Africa....... I used to listen to the radio and follow matches between WI vs ENG in the years when I spent in jail and also inspired.'ভিভ শুধুই একটা ৫০.২৩ এর গড় নয়, শুধু 'হিটিং অ্যাক্রোস দ্য লাইন' এর একটা অটোবায়োগ্রাফি নয়, ভিভ মানে একটা স্ফূলিঙ্গ, যার স্পর্শে হোল্ডার পোলার্ডের হাঁটু নেমে আসে মাটিতে, মুঠো করা হাত উঠে যায় প্রতিবাদের অভীপ্সায় জর্জ ফ্লোয়েড এর স্মরণে। একতায় বলে ওঠে ওরা 'I can't breathe Mama! I can't breathe.'

সত্তর আর আশির দশকে ব্যাট দিয়ে প্রতিপক্ষ বোলিং লাইনআপ খুন করত ভিভ। ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট হচ্ছে স্যার ভিভ রিচার্ডস অ্যান্টিগা ফুটবল দলেও খেলেছেন৷  ১৯৭৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে তিনি মাঠে নামেন। আরেকটা ফ্যাক্ট, শচীন তেন্ডুলকারের আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জেতা। ক্রিকেট বোঝা, খেলার  পর থেকেই তার এই স্বপ্নটা। চার বিশ্বকাপ খেলে পঞ্চম বিশ্বকাপে (২০০৭) এসে বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার কাছে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ যাওয়ার পর শচীনের স্বপ্নটা ভেঙ্গে যাওয়ার পথেই ছিল!  

২০০৭ বিশ্বকাপ থেকে ফিরে প্রচণ্ড হতাশ শচীন ভেবেছিল ক্রিকেটের পাঠ চুকিয়ে নিবেন! তার মাথায় আসে অবসরের ভাবনা। তার কেরিয়ারের অন্যতম খারাপ দিনগুলোতে তখন তাকে তার ব্যাটিং হিরো স্যার ভিভ রিচার্ডস কল দেন। কল দিয়ে বলেন; 'অবসর নিও না! তোমার কেরিয়ার এখনও বাকী; আরও অনেক কিছু দেওয়ার রয়েছে তোমার দলকে!' 

এরপরে শচীন আবার তার স্বপ্নের পেছনে ছোটা শুরু করে। একটা বিশ্বকাপ জয়। অবশেষে ২০১১ বিশ্বকাপে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! শচীনের স্বপ্ন পূরণ হয়, বিশ্বকাপ জেতে ভারত। 

সেই ফোন কলটার জন্য স্যার ভিভ ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছ থেকে একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন। 'ENDDULKAR?' থেকে শচীনের স্বপ্নপূরণ হওয়া। একশ আন্তর্জাতিক শতক দেখা; আরও বহু মহাকাব্যিক ইনিংস দেখায় সেই ফোন কলটার গুরুত্ব তো অনেক।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...