স্বামী পরিত্যক্তা, রিক্তা এই নারী চিরকাল একাকিনী জীবন কাটিয়েছেন

প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর নিমাই যখন পূর্ববঙ্গ থেকে ফিরে আসেন তাঁর শচী মা ছেলেকে আবার সংসারী করার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। এদিকে ছেলের মনের মত মেয়ে পাওয়া যায় না। একদিন গঙ্গার ঘাটে স্নান করতে গিয়েছিলেন নিমাইয়ের মা শচীদেবী। সেখানেই এক ছোট্ট মেয়ে তাঁর নজর কাড়ে। ফুলের মত মুখ, দীঘির মতো চোখ। শান্ত, অপরূপা। দুই চোখে যেন শান্ত আবহাওয়া দেখেছিলেন শচীদেবী।

শচীদেবী খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ছোট্ট মেয়েটি নবদ্বীপের এক বৈদিক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ সনাতন মিশ্রের কন্যা। মেয়েটিকে মনে ধরে শচী দেবীর। শচী দেবীর কথায় নবদ্বীপের এক পন্ডিত কাশীনাথ পন্ডিত ঘটকালি করেছিলেন এই বিয়ের। যথাসময়ে বিয়ে সম্পন্ন হয়।

ছোট্ট বিষ্ণুপ্রিয়া সংসারে এসে খেলার ছলে সংসার করতে থাকেন। বিয়ের পর প্রথমবার স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বাসর ঘরে যাওয়ার সময় বিষ্ণুপ্রিয়ার পায়ে নাকি চোট লেগেছিল। ছোট্ট মেয়েটি আশা করেছিল স্বামীর যত্ন। কিন্তু নিমাই উদাসীন, সাধনায় ডুবে থাকা মানুষ। বিষ্ণুপ্রিয়া তখনো তবে বুঝতে পারেননি সংসারে একাকিনী থাকতে হবে তাঁকে।

স্বামীর কাছে যখন নিজের পায়ের চোটের কথা বলতে গিয়েছিলেন স্বামী খেয়াল করেননি। ছোট্ট বিষ্ণুপ্রিয়ার মনে অভিমানের শুরু সেদিন থেকেই। বিষ্ণুপ্রিয়ার বয়স তখন এগারো-বারো বছর। নিমাইয়ের বয়স তখন একুশ বছর। ছোট্ট বিষ্ণুপ্রিয়া সংসার নিয়ে মেতে থাকতেন। নিমাই মেতে থাকতেন তার পুঁথিপাজি এবং শিষ্য নিয়ে।

এই সময় নিমাই পিতৃকার্য সম্পন্ন করতে গয়া যান। বিষ্ণুপ্রিয়ার ভাগ্যের বদল শুরু হয় এখান থেকেই। গয়া থেকে যেন একুশ বছরের উদাসীন নিমাই ফিরে আসে না বরং শ্রীকৃষ্ণ-প্রেমে পাগল এক সাধক মানুষ ফিরে আসেন। সারাক্ষণ কৃষ্ণ নাম জপ করতে থাকেন নিমাই।

নবদ্বীপে তাঁর নিত্যনতুন ভক্ত জুটতে থাকে। অবশেষে ১৫০৮ সালে নিমাই গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এরপরে তিনি শ্রীচৈতন্য হন।  চব্বিশ বছর বেঁচে ছিলেন শ্রীচৈতন্য এরপর। বিভিন্ন   তীর্থস্থানে রাধা-কৃষ্ণ তত্ত্বের অভিনব রূপায়ণে ধর্মমত স্থাপন করতে ব্যস্ত ছিলেন তিনি।

তা সেই ছোট্ট বিষ্ণুপ্রিয়া কোথায় গেল? শুরুর দিকে দু'বছর স্বামীর সঙ্গে খেলার ছলেই সংসার করেছিলেন তিনি। তারপর স্বামী যখন গয়া থেকে ফেরেন, সাধক শ্রী চৈতন্যর সঙ্গে আর সংসার করা হয়নি বিষ্ণুপ্রিয়ার। উদাসীন স্বামীর কৃষ্ণলীলা এবং সাধনার সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করেন বিষ্ণুপ্রিয়া।

বিষ্ণুপ্রিয়া প্রথম যখন জানতে পারেন যে তার স্বামী সন্ন্যাস গ্রহণ করবেন ছোট্ট বালিকা কেঁদে ভাসিয়েছিল। স্বামীর গলা জড়িয়ে কাকুতি-মিনতি করেন। নিমাই বিষ্ণুপ্রিয়াকে সোহাগ করে ঘুম পাড়িয়ে পা টিপে টিপে বিছানা থেকে ঘরের বাইরে এসে রাতের অন্ধকারে চলে যান। সকালে উঠে বিষ্ণুপ্রিয়া শূন্য শয্যা, শূন্য গৃহের সঙ্গে পরিচিতা হন। সেই শূন্যতা এক ধাক্কায় অনেকটা বড় করে দিয়েছিল ছোট্ট কিশোরী বউকে।

তবে এরপরও তিনি স্বামীর প্রতি কোন অভিযোগ করেননি। নীরবে একাকী সংসার ধর্ম পালন করে গেছেন। স্বামীর প্রতিও কোনদিন কোন অভিযোগ করেননি। স্বামীর লীলাবসানের পরেও বিষ্ণুপ্রিয়া প্রায় ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন সংসার নিয়েই থেকেছেন। তবে শাশুড়ি বড় ভালবাসতেন বিষ্ণুপ্রিয়াকে।

তাই শ্বাশুড়ির সেবা-যত্ন করেছিলেন শেষদিন পর্যন্ত। স্বামীর কৃষ্ঞপ্রেমকে গ্রহণ করেছিলেন নিজের জীবনেও। স্বামীর সঙ্গে যখন দ্বিতীয়বার দেখা হয়, স্বামীকে আর সংসারে ফেরানোর চেষ্টা করেননি। অভিমান, একাকিত্ব নিয়েই বাকি জীবন কাটিয়েছেন এই অভিমানিনী নারী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...