তাঁর নামটা যে ‘বিরাট’ থুড়ি ‘কিং কোহলি’!

প্রাক্তন শ্রীলংকার অধিনায়ক অরবিন্দ ডি সিলভার মতে , "যে ভাবে বিরাট একটা ম্যাচকে নিয়ন্ত্রণ করেন, যে আত্মবিশ্বাস এবং আগ্রাসন মাঠে দেখান, তা আমাকে ভিভ রিচার্ডসের কথা মনে করিয়ে দেয়।" আর  ভিভ রিচার্ডের মতে, ''বিরাটকে কেউ কিছু বললে বা করলে সেটা সুদে-আসলে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ওর আছে। যারা ভাল লড়াই থেকে পিছিয়ে যায় না তাদের আমার ভাল লাগে। বিরাট সে রকমই একজন। ওর মধ্যে দারুণ চনমনে একটা ব্যাপার আছে...'' ।

viratkohli1662652845070

আসলে তাঁর নামটা যে বিরাট কোহলি থুড়ি কিং কোহলি। এই সময়ের বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ব্যাটার। বিরাট কোহলি স্পেশাল। কোনও একজনের কাছে নয়। বিরাট কোহলি দেশের জন্য স্পেশাল। দেশের ক্রিকেটের জন্য স্পেশাল। প্রতিদিন তাঁর ব্যাটে লেখা হয় ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন কাহিনী। একবার সুনীল গাভাস্কার তো বলেই ফেলেছিলেন, ''এতদিন শুনতাম লোকজন বলত, আমি শচীন হতে চাই বা আমি গাভাস্কার হতে চাই। এখন সবাই বলবে আমি ‘কোহলি’ হতে চাই'

বিরাট তখন ২২টা ওয়ান ডে সেঞ্চুরি করে তাঁর কৃতিত্বে হাত রেখেছিল, সেই সময় উচ্ছ্বসিত সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলো, "কোহলি দারুণ প্লেয়ার। আমার সেঞ্চুরির সংখ্যা ও অবধারিত ভাঙবে। আরও অনেক সেঞ্চুরি করবে। তবে শচীনকে টপকাতে পারবে কি না জানি না। শ্চীন অনেক দূরে (৪৯)!" এখন বিরাটের ওয়ান ডে সেঞ্চুরি সংখ্যা ৪৩।

কিছুদিন আগে চলতি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচ বার করে আনা ইনিংস দেখে সৌরভ বলেন, ''এক কথায়, বিশেষ প্রতিভা। আমাদের সময় থেকে কয়েক জন বিশেষ প্রতিভা দেখেছি। শ্চীন (তেন্ডুলকর), রাহুল (দ্রাবিড়)। কোহলিও সে রকমই বিশেষ প্রতিভাসম্পন্ন। সাদা বলের ক্রিকেটে তো অতুলনীয়। কী সব ইনিংস খেলেছে, কী সব ম্যাচ জিতিয়েছে!''

চেজিং মেশিন কোহলির বিষয়ে প্রিন্স অফ ক্যালকাটার মত, ''শুধুই রান তাড়া করার সময় বিরাট সেরা, সেটা আমি মানি না। রান তাড়া করি বা প্রথমে ব্যাট করি, বিরাট অসাধারণ। না হলে এত রান করতে পারে! আজও তেমনই একটা ইনিংস খেলল। চাপের মুখে ওই ইনিংস, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ, সকলের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা ব্যাটিং। অনবদ্য, অনবদ্য!''

অবশ্য ইমরান খানের মতে, ''ওর ট্যালেন্ট ও টেকনিককে বাইরে রেখেই বলছি ওর টেমপারামেন্ট খুব ভাল। ওর টেম্পারমেন্ট শচীনের থেকে ভাল। কোহলি খুব কঠিন সময়ে নিজের খেলাটা খেলে যেতে পারে। যেটা শচীন কখনও কখনও পারেনি।'' তিনি আরোও বলেন, '' আমার দেখা বিরাট কোহলি একজন সম্পূর্ণ ক্রিকেটার। ''

আর শচীনের মতে ''ছেলেটা বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হতে চলেছে। শুধু এই প্রজন্মই নয়। সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটারদের একজন বিরাট।''

আরেক সাক্ষাৎকারে মাস্টারব্লাস্টটার বলেছিলেন, ''ব্যাটটা সোজা রেখে ও শটগুলো নেয়। বড় রানগুলো নিখুঁত শটে নেয় ও। এর জন্য যেমন প্রচন্ড পরিশ্রম দরকার, তেমনই প্রয়োজন অধ্যবসায়। মানসিক ভাবেও বিরাট খুব শক্তিশালী। টেকনিকের সঙ্গে কোনও রকম আপস না করে সব ফর্ম্যাটের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারাটা ওর আর একটা বড় গুণ। চাপ সামলানোর ক্ষমতাও ওর খুব ভাল।''

তাঁর সঙ্গে সহমত প্রাক্তন পাকিস্তান পেসারও। ওয়াসিম আক্রমের কথায়, ''ওকে কখনও রিভার্স শট বা বাজে শট খেলে রান নিতে দেখিনি। নিখুঁত শট খেলে আর ব্যাট সবসময় সোজা। এ রকম একজন ব্যাটসম্যান যে কোনও বোলারের কাছেই ত্রাস। বিরাট একটা আইপিএলেই ৩৬টা ছয় মেরেছে। আমি তো সারা ক্রিকেট জীবনে হয়তো গোটা ৫০ ছয় মারতে পেরেছি।'' একই সঙ্গে আক্রম যোগ করেন, ''আমাকে যদি ওর বিরুদ্ধে বল করতে হত, তা হলে অবশ্যই চিন্তায় থাকতাম। ওয়ান ডে-তে শচীন যখন ওপেন করত, তখন যেমন হত। শচীন আর বিরাটের মতো ব্যাটসম্যানদের বল করা খুব কঠিন। কারণ, ওদের আউট করার সুযোগ পাওয়াই মুশকিল।''

কুমার সঙ্গকারার মতে, ''ও ক্রিজে থাকলে মনেই হয় না ভারতকে হারানো সম্ভব! ফিল্ডিংয়ের ফাঁক খুঁজে নিয়ে শট খেলার পাশাপাশি স্ট্রাইকটাও রোটেট...দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাটিং! বিরাটের দাপটটাই আজকাল দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে ক্রিকেট বিশ্ব।''

বিরাট কোহলিকেই সাদা বলের ক্রিকেটের সেরা ব্যাটার হিসাবে বেছে নিয়েছেন রিকি পন্টিংও। কোহলির ব্যাটিংয়ে মুগ্ধ তিনি। বিশ্বকাপ শুরুর আগে ভারত-অস্ট্রেলিয়া প্রস্তুতি ম্যাচে ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন পন্টিং। সেই ম্যাচে তেমন রান পাননি কোহলি। তবু ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ককে নিয়ে আলোচনার সময় দরাজ প্রশংসা করেন পন্টিং।

ধারাভাষ্যকার পন্টিং বলেছেন, ''ওর থেকে ভাল সাদা বলের কোনও ক্রিকেটার দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।'' ব্যাটারের মতো অধিনায়ক কোহলিকে নিয়েও উচ্ছ্বসিত অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অধিনায়ক। পন্টিং বলেছেন, ''দলকে দারুণ নেতৃত্ব দিত কোহলি। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেই টেস্ট জয় তো দুর্দান্ত। তবে, ওর থেকে ভাল সাদা বলের ক্রিকেটার দেখেছি কি না, নিশ্চিত নই। এক দিনের ক্রিকেটে কোহলির কীর্তি অভাবনীয়। কী অসাধারণ পরিসংখ্যান।''

৫ নভেম্বর, ১৯৮৮। প্রেম ও সরোজ কোহলি দম্পতির সন্তান বিরাট কোহলি দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা পেশায় আইনজীবী ছিলেন। ২০০৬ সালে বিরাটের বাবার মৃত্যু হয়। ১৭-১৮ বছরের একটি ছেলের মাথার উপর থেকে যখন বাবার হাত উঠে যায় তখন সে হঠাৎ করেই অনেকটা বড় হয়ে যায়। দায়িত্ববোধ বেড়ে যায়। সেটাই হয়েছিল বিরাটের।

ভোররাতে মারা যান প্রেম কোহলি। ক্রিকেট জীবনের প্রথম রঞ্জি টুর্নামেন্ট খেলছেন। ম্যাচ চলছিল কর্নাটকের বিরুদ্ধে। দিল্লির হয়ে আগের দিন ৪০ রানে অপরাজিত ছিলেন তিনি। পরের দিন সকালে সেই চূড়ান্ত শোকের মধ্যেই ব্যাট করতে গিয়েছিলেন। ইস্পাতকঠিন মানসিকতার ভিতটা হয়ত শক্ত হয়েছিল সে দিনেই। বিরাট কোহলি নেমে পড়েছিলেন ব্যাট হাতে। চাপে থাকা দলকে উদ্ধার করে তাঁর ৯০ রানের ইনিংস।

16kingkohli

এক সাক্ষাৎকারে কোহলি বলেছিলেন, "আমার হাতের ওপরেই মারা যান বাবা। ভোর তখন তিনটে। বাবাকে কোনও চিকিৎসা দিতে পারিনি। প্রতিবেশীদের থেকে সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। যাঁদের ডাক্তার বলে চিনতাম, তাঁদের ফোন করেছিলাম। কিন্তু এত রাত হয়ে গিয়েছিল যে, কেউই সাড়া দেননি। যখন অ্যাম্বুল্যান্স ও অন্যান্য ব্যবস্থা করা গেল, তত ক্ষণে সব শেষ।"

ওই সাক্ষাৎকারে বিরাট বলেছিলেন, "বাবার মৃত্যুর ঘটনা আমার ফোকাস বাড়িয়ে দিয়েছিল। অন্য আর সব কিছুতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে সমস্ত এনার্জি এক জায়গায় এনে ফেলেছিলাম।"

ছোটবেলা থেকেই খেলা নিয়ে আবেগপ্রবণ বিরাট। বিরাটের ছোটবেলার কোচ রাজকুমার শর্মা জানান,  "আমার কাছে এসেছিল ন'বছর বয়সে। ১৫-২০ দিন অনুশীলন করার পরই বুঝতে পেরেছিলাম ও কিন্তু বাকিদের থেকে আলাদা। 'গড গিফটেড' প্রতিভা ছিল। ওকে কিছু শেখাতে হত না সে ভাবে। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী ছিল। সঙ্গে খাটতে কোনও ক্লান্তি ছিল না। যখন যা বলা হত তাই করত। ছোটবেলা থেকেই খুব পরিণত।"

মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের শিরোপা বিজয়ী ভারতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন বিরাট। বিশ্বকাপ জয়ের কয়েকমাস পরে ১৯ বছর বয়সে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ভারতের হয়ে ওয়ান ডে তে অভিষেক হয়েছিল তাঁর। ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে দ্রুততম ব্যাটসম্যান হিসেবে ১০,০০০ এবং ১১,০০০ রানের বিরাট কৃতিত্ব কোহলিরই দখলে।

২০১৭ সালের প্রথম দিকে, ধোনি অধিনায়ক পদ থেকে পদত্যাগ করার পরে তিনি ওয়ানডেতেও অধিনায়ক হন। তার আগেই পেয়েছিলেন টেস্ট অধিনাপদ। সেই প্রথম গোটা একটা টুর্নামেন্টে নেতৃত্বের দায়িত্ব ছিলো বিরাটের উপর। সেই সময় রাজকুমার শর্মা বলেছিলেন, "বিরাটের নেতৃত্বে কোনও কিছুর খামতি দেখলাম না। ধোনি যেমন মাঠে কোনও রকমের আবেগ দেখায় না, একদম ঠান্ডা থাকে, বিরাট সে রকম নয়। ওকে দেখে মাঝে মাঝে সৌরভের ক্যাপ্টেন্সি মনে পড়ে যাচ্ছিল। হ্যাঁ, বিরাট অনেকটাই দাদা 'মোড'-এর ক্যাপ্টেন। সৌরভের প্যাশন, সৌরভের আগ্রাসনটা ওর মধ্যে আছে।"

যদিও সৌরভের মতে, ''আমার মনে হয়, বিরাট আমার চেয়ে দ্বিগুণ আগ্রাসী। আমি যখন বিরাটকে খেলতে দেখি তখন কাজের টেবলে বসে থাকা যায় না। উঠে টিভির সামনে বসে ওর খেলাই দেখতে ইচ্ছে করে। এটাই ওর খেলা। ওর তীব্রতা ওর প্যাশন অবিশ্বাস্য।''

অধিনায়কত্বের প্রথম স্বাদের বিষয়ে কোহলি নিজে বলেছিলেন, "মনে আছে, ওটা অ্যাডিলেড ছিল। ড্রেসিংরুমে প্লেয়ারদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা একটা হয়েছিল। আমি বলেছিলাম যে, যা-ই হোক, কাল অস্ট্রেলিয়া যত টার্গেটই দিক, আমরা সেটা তাড়া করব। আমি টিমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওরা তা নিয়ে সহমত কি না। সেটা চায় কি না। ওরা বলল, রাজি। অস্ট্রেলিয়া যতই দিক, ওরা সেটাকে তাড়া করবে।

পরের দিন আমরা রান তাড়া করে হেরে গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু আমার টিমের সাহস, চরিত্র— সব পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। সে দিনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে, আমার টিম ঝুঁকি নেবে। নিজেদের কমফোর্ট জোনে না থাকলেও এমন কিছু জিনিস করতে চাইবে, যাতে টিমের লাভ। করবে শুধু টিমের স্বার্থের কথা ভেবে।"

বিদেশে পারফরম্যান্সের বিষয়ে প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক বলেছিলেন, "বিশ্বের যে কোনও মাঠেই আমি যা-ই না কেন, জেতাটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য থাকে। ক্রিকেটটা তো সে ভাবেই খেলা হয়। আমি অন্তত সে ভাবে খেলি। মাথায় রাখি যে, যদি জিতি, খুব ভাল। বড় অ্যাচিভমেন্ট। কিন্তু হারলে দুনিয়া শেষ হয়ে যাবে না। কেউ সব ম্যাচ জিততে পারে না। পারলে তো অজেয় হয়ে যেত। কিন্তু সেটা কারও পক্ষে হওয়া সম্ভব নয়। ফাঁকফোকর আমাদেরও আছে। ভুল আমরাও করি। কিন্তু আমরা নিজেদের উন্নত করার চেষ্টা করে যাই। সেই চেষ্টাটা সব সময়ই থাকে।"

ব্যাটসম্যান কোহলি, ক্যাপ্টেন কোহলি এই বিষয়ে বিরাটের মতে, "নিজেকে প্রথমে ভারতের টেস্ট ক্রিকেটার ও তার পরে টেস্ট ক্যাপ্টেন হিসেবে ভাবলে খুব গর্ব হয়। একটা টেস্ট টিম হিসেব ভাল খেলা আমার দায়িত্ব। আমি সেটা উপভোগও করি। সাদা জার্সি পরে মাঠে নামাটা আমার কাছে গর্বের একটা বিষয়। কারণ টেস্ট ক্রিকেট আপনার যে ভাবে পরীক্ষা নেবে, কেউ নেবে না।"

এখন তিনি আর অধিনায়ক নন। কিন্তু চলতি টি-টয়েন্টি বিশ্বকাপে বিরাট সব রেকর্ড গড়ছেন তিনি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সপ্তম ওভারের পঞ্চম বলে তাসকিন আহমেদকে মিডউইকেটে ঠেলেই নজির গড়ে ফেলেন বিরাট কোহলি। শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন অধিনায়ক মাহেলা জয়বর্ধনেকে টপকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রানের মালিক হয়ে গেলেন তিনি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোহলি অপরাজিত থাকলেন ৬৪ রানে। অর্থাৎ বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত ১০৬৫ রান হল কোহলির

বুধবার ম্যাচের পরেই রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের টুইটারে একটি ভিডিয়ো পোস্ট করা হয়। শ্রীলঙ্কার মাহেলা জয়বর্ধনে সেখানে কোহলিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন, "রেকর্ড ভাঙার জন্যেই তৈরি হয়। কেউ না কেউ এক দিন ঠিক আমার রেকর্ড ভেঙে দিত। বিরাট, দারুণ কাজ করেছো। বরাবরই তুমি এক জন যোদ্ধা। ছন্দ সাময়িক, কিন্তু প্রতিভা চিরকালীন। চালিয়ে যাও বন্ধু।"

৩১ ম্যাচে সমসংখ্যক ইনিংসে ১০১৬ রান করেছিলেন জয়বর্ধনে। কোহলির ৬টি ম্যাচ এবং ৮টি ইনিংস কম লাগল শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন অধিনায়ককে পেরিয়ে যেতে। তিনি ২৫টি ম্যাচ খেলে ২৩তম ইনিংসে এই নজির গড়লেন। দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচেই বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যাটার হিসাবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ১০০০ রান হয়ে গিয়েছিল ভারতের প্রাক্তন অধিনায়কের।

নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের প্রাক্তন ওপেনার ক্রিস গেলকে টপকে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছিলেন কোহলি। বিশ্বকাপে ৩৩টি ম্যাচ খেলে গেল করেছেন ৯৬৫ রান। তালিকার চতুর্থ স্থানে রয়েছেন আরও এক ভারতীয়। তিনি অধিনায়ক রোহিত শর্মা। বিশ্বকাপে ৩৭টি ম্যাচ খেলে রোহিতের সংগ্রহ ৯২১ রান। সক্রিয় ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনি একমাত্র কোহলির কাছাকাছি রয়েছেন। এ ছাড়া সক্রিয় ক্রিকেটারদের মধ্যে বাংলাদেশের শাকিব আল হাসান ৩৫ ম্যাচে ৭২৯ রান করে সপ্তম স্থানে রয়েছেন। বাকি আর কেউ কোহলির ধারেকাছে নেই।

বাংলাদেশ ম্যাচের পর বিপক্ষ দলের নেতা সাকিব আল হাসান বললেন, "ভারতের বিরুদ্ধে আমরা বরাবরই ভালো খেললেও শেষ মুহূর্তে কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমরা অন্তিম হার্ডলটি টপকাতে ব্যর্থ হই। আজও তাই হয়েছে। আর তার কৃতিত্ব অনেকটাই বিরাট কোহলিকে দিতে হয়। উনি যেভাবে ব্যাটিং করছেন তাতে এখন যে কোনও ম্যাচ ভারতকে উনি একার হাতেই জেতাতে পারেন।"

বর্ষসেরা ক্রিকেটার। সেরা টেস্ট ক্রিকেটার। সেরা ওয়ানডে ক্রিকেটার। ২০১৯ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের ঘোষিত এই তিন পুরস্কারই জিতেছেন বিরাট কোহলি। যা নজিরবিহীন। এর আগে কোনও ক্রিকেটার একইসঙ্গে এই তিন পুরস্কার জিততে পারেননি। ইতিহাস সৃষ্টি করলেন তিনি।

ফিটনেসই যে তাঁর সাফল্যের মূলে, এটা বরাবর বলে এসেছেন তিনি। তাই ম্যাচ খেলুন বা বিশ্রামে থাকুন, জিমে যাওয়া কখনও বাদ দেন না। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও যথেষ্ট সচেতন। যোগ্যতম হিসাবেই ভারতের সবচেয়ে ফিট ক্রিকেটারের নাম বিরাট কোহলি। বোর্ডের প্রকাশিত সাম্প্রতিক রিপোর্টে চোখ বোলালে তেমনটাই জানা যাচ্ছে।

সম্প্রতি জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির (এনসিএ) পারফরম্যান্স নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বোর্ড। সেখানে সবচেয়ে ফিট ক্রিকেটারের নাম দিয়ে তালিকা প্রকাশ করা হয়নি ঠিকই। তবে কারা ক'বার এনসিএ-তে চোটের শুশ্রূষা করতে গিয়েছেন, সেই তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ২০২১-২২ মরসুমে এক বারও চোট সারাতে এনসিএ-তে যেতে হয়নি কোহলিকে। বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তিতে থাকা ২৩ জন ক্রিকেটার চোট সারাতে এনসিএ গিয়েছেন। সেই তালিকায় শুধু নেই কোহলির নাম।

কোহলির ফিটনেস সম্পর্কে বোর্ডের এক সূত্র সংবাদ সংস্থাকে বলেছেন, "বেশির ভাগ ক্রিকেটার মাঠেই চোট পেয়েছেন। সূর্যকুমারের মতো কারওর হাড়ে চিড় ধরেছে। অনেকে একই চোট নিয়ে একাধিক বার এসেছে। কিন্তু কোহলি নিজেকে এতটাই ফিট রেখেছে যে কখনও হ্যামস্ট্রিং বা পেশির চোটেও ওকে এনসিএ যেতে হয়নি।" তুলনায় এমন ক্রিকেটাররা এনসিএ-তে গিয়েছেন, যাঁরা কোহলির থেকে ১০ বছরের ছোট। তাঁদের মধ্যে শুভমন গিল, পৃথ্বী শ, রুতুরাজ গায়কোয়াড়, বেঙ্কটেশ আয়াররা রয়েছেন।

২০১৮-র সেঞ্চুরিয়নের শতরান টাও ফিটনেসের উদাহরণ বলাই যায়। ১৬০ রানের অপরাজিত ইনিংস আসে কোহলির ব্যাট থেকে। কোহলির লেগেছিলো ১৫৯ বল। গড় ১০০.৬২। এই ১৬০ রানের মধ্যে ১০০ রান বিরাট কোহলি নিয়েছিলেন দৌড়ে। বাকি ৬০ রান এসেছে বাউন্ডারি ও ওভার বাউন্ডারি থেকে।

কোহলিই প্রথম ভারতীয় যার ব্যাট থেকে একদিনের ম্যাচে ১০০ রান আসে শুধু দৌড়ে। বিশ্বের পঞ্চম ব্যাটসম্যান তিনি। এর আগে ভারতীয়দের মধ্যে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় সর্বোচ্চ ৯৮ রান করেছিলেন দৌড়ে। সেই ম্যাচে ১৯৯৯ সালে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ১৩০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি।

ম্যাচ শেষে বিরাট জানান ১০০ রান তিনি দৌড়ে কতটা কষ্ট করে নিয়েছিলেন। কারণ ম্যাচটা তিনি ক্র্যাম্প নিয়ে খেলেছেন। বিরাট বলেন, ''শেষের বেশ খানিকটা সময় আগে আমার ক্র্যাম্প হয়ে গিয়েছিল।কিন্তু আমি জানতাম দলের ৩০০ রান হওয়ার আগে আউট হওয়া যাবে না। এটাই সময় ছিল মানসিক ও শারীরিকভাবে পরীক্ষার।''

বিরাটের ট্রেনার ও ফিটনেস কোচ শঙ্কর বাসু একবার বলেছিলেন,''লোকে ভাল কোচ পেয়ে বর্তে যায়। আমি তো কোচ হয়ে বিরাটের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়ে বর্তে গিয়েছি।'' শঙ্কর বলেন, ''যখনই প্রয়োজন পড়েছে, তখনই বিরাট সমানে প্রচন্ড পরিশ্রম করে গিয়েছে। শৃঙ্খলা ও নিজের খাওয়ার অভ্যাসের দিক থেকে ও প্রচন্ড কঠোর।''

কোহলির ফিটনেস-পাগলামির কথা বলতে গিয়ে শঙ্কর বলেন, ''বিরাট এখন বিশ্বের সেরা অ্যাথলিট হওয়ার দিকে দৌড়চ্ছে। যার কোনও সীমা নেই। এই ব্যাপারে ওর কয়েকজন রোল মডেল আছে। আর ও তাদের মতো হওয়ার জন্য বোধহয় কোনও চ্যালেঞ্জের সঙ্গেই সমঝোতা করবে না। বরং ঝাঁপিয়ে পড়বে।''

বিরাটের এক্স ফ্যাক্টর হল ওর প্রতিযোগিতা জিততে চাওয়ার উদগ্রতা! টেকনিক্যালি ভাল সেটা তো একটা বড় দিক। ওটা না হলে এই পর্যায়ে যেতেই পারত না। কিন্তু তার বাইরেও নিজেকে নিয়ে এক ধরনের উচ্চাশা থাকে। বিরাটের মধ্যে সেই উচ্চাশাটা খুব পরিষ্কার যে, আমার টিমে আমি বাকি সবার চেয়ে অনেক ভাল হব। আর বড় টুর্নামেন্ট জিতব। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্যাশনটাই ওর এক্স ফ্যাক্টর। এটাই ওকে বাকিদের চেয়ে আলাদা করে দেয়। এই জন্যই যত বার বিশ্বকাপ বা এই জাতীয় বড় ম্যাচ হবে, বিরাট তত ভাল খেলবে!

 

নিবন্ধকারঃ ঋদ্ধি রিত

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...