যোদ্ধাদের মৃত্যু হয়না। বিক্রম বাত্রা, এই নামটির সঙ্গে আজ আসমুদ্রহিমাচল আমরা সকলেই পরিচিত। যাঁর নামে বিক্রম সে তো পরাক্রমী হবেনই।
কিছু কিছু মানুষ মৃত্যুকে জয় করে ফেলেন। মৃত্যু জীবনের অমোঘ সত্যি। তার সামনে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে বলে ফেলেন, 'তুমি যেই হয়, তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড় নও'। জন্ম আমাদের অনভিপ্রেত হলেও মৃত্যু কিন্ত নিশ্চিত, অনিবার্য। বিক্রম সেই অনিবার্য সত্যিটাকেও হেলায় হারিয়ে আজ মৃত্যুঞ্জয়ী।পরমবীর চক্র বিজয়ী, এক বীর যোদ্ধা।
এলওসি কার্গিল সিনেমাটা মনে পড়ে? সেই ছবিতে হাজারো চরিত্রের ভিড়ে, অভিষেক বচ্চনের একটি চরিত্র, হ্যাঁ সে'ই শেরশাহ। বিক্রম বাত্রা। হাল আমলে শেরশাহ দেখলেন তো নিশ্চয়ই দেখছেন! একজন অভিনেতা বিক্রমের চরিত্রে অভিনয় করেই মানুষের এতোটা হৃদয়ের কাছে চলে এলেন, তাহলে আসল বিক্রম কেমন ছিলেন। সত্যি সত্যিই শের দিল, তাই তো সেনাবাহিনীই তাঁকে শেরশাহ নামই দিয়েছিল।
আর সে নামের যোগ্য মান তিনি শেষ পর্যন্ত রেখেছিলেন। না ছিলেন নয়, আজও রাখছেন। ২৯ জুন ১৯৯৯ সালে বিক্রম বলেছিলেন তাঁর মাকে, 'ঠিক হুঁ, ফিকার মত কারো'। এই বাড়ির সাথে তাঁর শেষ কথা। রণাঙ্গনে দাঁড়িয়ে আশ্বস্ত করেছিলেন পার্থিব জননীকে। আসলে সে যে তখন দেশমাতার সেবায় ব্যস্ত। বিক্রম একটা অদম্য বীরগাথার নাম, যেদিন হংকং-এর ভালো চাকরি পেয়েও যাননি, সেদিন মাকে বলেছিলেন, বড় কিছু করবেন। সত্যিই করলেনও তাই।
কার্গিল, এই নামটা আমাদের মুখে মুখে ঘোরেফেরে। কার্গিল মানে আমাদের দেশের সন্তানদের বীরগাথা। সেই উপাখ্যানের এক নায়ক ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা। হয়ত ভারত তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের উদ্দেশ্যে আজও বলে চলেছে, 'আমি ভারতবর্ষ আমি দেখেছি, আমার সন্তানের মরণ, তারুণ্যের মরণ। আমি মৃত্যুকে জয় করা কার্গিল বিজয় দেখেছি। আমি মৃত্যুকে জয় করে আমার সন্তানকে অমর হতে দেখেছি।'
১৯৭৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর জন্ম হয়েছিল বিক্রমের বাত্রার। দুই যমজ ভাই, বিক্রম আর বিশাল। বিক্রম ১৪ মিনিটের বড়, বাত্রা ভাইদের ডাক নাম বড় সুন্দর ছিল লব আর কুশ। নামেই যখন লব কুশ, রামায়ণ তো হবেই।
ছোটবেলা থেকে টেনিস ও ক্যারাটেতে খুব ভালো ছিলেন বিক্রম। ডিএভি স্কুল ও সেন্ট্রাল স্কুল থেকে পড়ার পরে ভর্তি হন ডিএভি কলেজে, সেখান থেকেই বিএসসি। ওই সময়েই এনসিসি। তারপর চণ্ডীগড়ে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন ইংরেজিতে স্নাতকোত্তরের জন্যে। পড়তে শুরু করলেন সেনাবাহিনীর চাকরির জন্যে, সার্ভিস সিলেকশান বোর্ডের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন।
১৯৯৫-৯৬ এর ঘটনা, ট্রেনিং সম্পূর্ণ করলেন এলাহাবাদ থেকে। ইংরেজিতে এমএ তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেননি। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি খুঁজে পান তাঁর ভালোবাসাকে। এই ভালোবাসাই আজও বাঁচিয়ে রেখেছে বিক্রমকে। কেবল ভালোবাসা নয়, এযেন এক সাধনা। এক অপেক্ষা। জীবনের ওপারে হয়ত ফের দেখা হবে তাঁদের। সেই অপেক্ষায় বেঁচে আছেন একজন। আর আরেক জন চলে গিয়েছেন বৈতরণীর ওপারে।
লেফটেন্যান্ট হিসেবে ভারতীয় সেনার জম্মু ও কাশ্মীর রাইফেলসের ১৩ তম ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সৈনিক জীবন শুরু করেছিলেন বিক্রম।
১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধের সময় তাঁকে দ্রাস সেক্টরে পাঠানো হয়, তখন উত্তরপ্রদেশে পোস্টেড ছিলেন তিনি। ৬ জুন তিনি দ্রাসে পৌঁছান। রাজপুতানা রাইফেলসের সেকেন্ড ব্যাটেলিয়নে তাঁকে রিজার্ভে রাখা হয়। সেই সময় তাঁকে ৫৬ মাউন্টেন ব্রিগেডে রিপোর্ট করতে হয়, সে সময় চলছে কার্গিল যুদ্ধ। ভূস্বর্গ তখন ভয়ংকর। উপত্যকা ঢেকে গিয়েছে আঁধারে। মৃত্যু মিছিল আর বীরগাথার ইতিহাস লেখা চলছে। সেই সময় রাজপুতানা রাইফেলসকে পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে টোলোলিং মাউন্টেন রিজ উদ্ধারের জন্যে পাঠানো হয়। ক্যাপ্টেন বাত্রাকে তাঁর উর্ধ্বতনেরা নাম দেন 'শেরশাহ'।
২০ জুন ক্যাপ্টেন বাত্রার নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে, ৫১৪০ পয়েন্ট জিতে নেয় ভারতীয় সেনা। সামনে থেকে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলন বিক্রম। পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইও হয় তাঁর। এরপর তিনি তাঁর উর্ধ্বতনের কাছে কোডে মেসেজ পাঠান 'ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর'।
অর্থাৎ তিনি বার্তা পাঠাতে চেয়েছিলেন যে, ভারতীয় সেনা ৫১৪০ শৃঙ্গের দখল নিয়েছে। এর পর ক্যাপ্টেন বাত্রাকে পয়েন্ট ৪৮৭৫ বিজয়ের জন্যে পাঠানো হয়। ভারতীয় পতাকা উত্তোলনের দায়িত্ব দেওয়া হয় ঐ পয়েন্টে। ৭ জুলাই ৪৮৭৫ পয়েন্টের উদ্দেশ্যে অভিযান শুরু করেন ক্যাপ্টেন বাত্রা ও তাঁর দল। এই পয়েন্ট রয়েছে মুশকো উপত্যকায়।
এই ৪৮৭৫ পয়েন্ট রয়েছে ১৬ হাজার ফুট উচ্চতায়। এই শৃঙ্গ উদ্ধারের অভিযান ছিল খুবই বিপজ্জনক। কারণ, উপর থেকে মেশিন গান নিয়ে ক্যাপ্টেন বাত্রা ও তাঁর দলকে লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল পাকিস্তানি সেনারা। ক্যাপ্টেন বাত্রার দলের একজনের পায়ে গুলি লাগে। সেইসময় দলকে নিরাপদে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন ক্যাপ্টেন।
সহকর্মী এক সুবেদারকে তিনি বললেন "তুমি বিয়ে করেছ তোমার ফ্যামিলি রয়েছে, তোমার কিছু হলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে, আমি ব্যাচেলর। আমি মারা গেলে কিছুই হবে না।" নায়কেরা তো এমনই হন। এ জন্যেই ইতিহাস লেখা হয়। বিক্রম নিজে চলে এলেন সামনে, শত্রুদের গুলির সামনে।
তখন তাঁরই উপর হামলা হয়, শুরু হয় গুলি বর্ষন। বুলেট থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নেন ক্যাপ্টেন বাত্রা, যদিও একটি রকেট-প্রপেলড গ্রেনেডের স্প্লিন্টার এসে তাঁর মাথায় আঘাত করে। সেখানেই শহিদ হন ক্যাপ্টেট বাত্রা। শেষ হয়ে গেল এক তরুণের জীবন। মাত্র ২৫ বছরের বিক্রম ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। দেশমাতৃকাকে রক্ষা করতে করতে তার কোলেই ফিরে গেলেন বিক্রম।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর দীর্ঘ লড়াইয়ে পরে কার্গিল যুদ্ধে জিত যায় ভারত। সফল হয় অপারেশান বিজয়। এরপর ক্যাপ্টেন বিক্রমকে মরণোত্তর পরমবীর চক্র সম্মানে সম্মানিত করা হয়। তদানিন্তন প্রেসিডেন্ট কেআর নারায়ণন ১৯৯৯-এর ১৫ অগাস্ট তাঁকে মরণোত্তর এই সম্মানে সম্মানিত করেন। চলচ্চিত্রের বিক্রম অর্থাৎ রিলের বিক্রম বলেছিলেন, "তিরঙ্গা লেহেরাকে লটুঙ্গা, ইয়া ফির তিরঙ্গা লপেটকে, লেকিন লটুঙ্গা জরুর" তাইই ফিরছিলেন বিক্রম, কফিনবন্দী হয়ে।
এটা কী কেবল এক বীরের পরাক্রমের গল্প! না এতো জীবনের গল্প। মৃত্যুকে জয় করা জীবনের গল্প। শুনবেন না সে গল্প? হ্যাঁ। ভালোবাসার গল্প। অপ্রাপ্তির গল্প। তার আগে জেনে ফেলি, রাষ্ট্র কীভাবে বিক্রমকে বাঁচিয়ে রেখেছে...এলাহাবাদের সার্ভিস সিলেকশন সেন্টারের একটি হলের নাম হয়েছে 'বিক্রম বাত্রা ব্লক'।
জব্বলপুর সেনানিবাসের একটি এলাকার নাম দেওয়া হয়েছে 'ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা এনক্লেভ'। আইএমএ -তে কম্বাইন্ড ক্যাডেটদের মেসের নাম 'বিক্রম বাত্রা মেস'। বাত্রা এবং তার সঙ্গীদের জন্য একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে তাঁর কলেজে। বিক্রম বাত্রার স্মৃতিতে পালামপুর সরকারি কলেজ নতুন নামকরণ করা হয়েছে, কলেজটির বর্তমান নাম শহীদ ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা সরকারি কলেজ রাখা হয়।
২০১৯ সালে দিল্লিতে ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রার সম্মানে নয়াদিল্লির মুকারবা চক ও উড়ালসেতুর নামকরণ করা হয় "শহীদ ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা চক"। পালমপুরের শহীদ ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রার নামে ওখানকার স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রার সম্মানে তাঁদের অত্যাধুনিক ইন্ডোর শ্যুটিং রেঞ্জটি উৎসর্গ করেছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রাকে তাঁর সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ২১ বছর পূর্তির জন্যে এক অনন্য শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন করে। সেনাবাহিনীর সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা একটি ভিডিও, সেখানে তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি বলেছেন সকলে "ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর" এবং সেখানে সবাই একটাই বাক্য বলেছে "আমিই বিক্রম বাত্রা"।
যেখানে বাত্রা শহীদ হন সেই পয়েন্ট ৪৮৭৫ এখন 'বাত্রা টপ' নামে পরিচিত।পরের বছর ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রার আত্মত্যাগের ২২তম বছরের স্মরণে সেনা কমান্ডার নর্দার্ন কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল কুমার যোশি সুখোই-30 এমকেআই-তে বিখ্যাত "বাত্রা টপ"-এর উপর দিয়ে উড়িয়েছিলেন এবং আকাশ থেকেই বীরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন।
এ তো গেল বীরের জন্যে দেশ কী করল তার কথা। কিন্তু কেমন আছেন ডিম্পল। হ্যাঁ বিক্রমের ভালোবাসার নাম ডিম্পল চিমা। যে একাকিত্ব নিয়েই কাটিয়ে দিল নিজের জীবন। শুধু সম্বল বলতে কয়েকটা স্মৃতি। আমরা মুহূর্তেই বাঁচি, ডিম্পলও তাই। সদ্য কুড়ির ঘরে প্রবেশ করা একটি মেয়ে, তাঁর প্রেমিকের মৃত্যুতে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন একা থাকবে বাকি জীবনটাতে।
এই না হলে ভালোবাসা। এই ভালোবাসা আর ত্যাগই অমর করে দিয়েছে বিক্রমকে। আজ প্রায় দু-দশকেরও বেশি সময় ধরে ডিম্পল ওঁর স্মৃতি নিয়েই অপেক্ষা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়তে গিয়ে প্রেম বিক্রম-ডিম্পলের। বিয়ের তারিখ পাকা ছিল, কিন্তু কার্গিল যুদ্ধ ডিম্পলের জীবন থেকে চিরতরে কেড়ে নিয়েছে তাঁর মনের মানুষ বিক্রমকে। বিক্রমের মৃত্যুর পর গত ২২ বছরে অবিবাহিতই আছেন ডিম্পল, বিক্রমের বাবা-মার শত আবদার অনুরোধ টলাতে পারেনি তাঁর সিদ্ধান্তকে।
কার্গিল যুদ্ধ হয়তো বহু বীরের কাহিনী, ২৪ বছর বয়সী বিক্রম বাত্রার অসীম সাহসিকতার কাহিনী, সেই সঙ্গে এটা বিক্রম-ডিম্পলের প্রেমের কাহিনীও। ডিম্পল বিশ্বাস করেন বিক্রম ওঁর আশেপাশেই আছে, ওঁর স্মৃতিতে ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা অমর। তাঁর কথায়, 'আমি ওর উপর একটু রেগে আছি এটা ঠিক, কিন্তু যেদিন দেখা হবে সেদিন সব মনোমালিন্য একসঙ্গে বসে মিটিয়ে নেবো। আমি জানি ঠিক দেখা হবে….'।
দিল বেচারার সাংলাপ মনে পড়ে যায়, যব তক মেরী রানি জিন্দা হ্যায়, মেরী কাহানী ভি বাকি হ্যায়...হ্যাঁ ঠিকই তাই যতদিন ডিম্পল থাকবেন, তত দিন বেঁচে থাকবেন বিক্রম। 'তেরা মেরা সাথ এহি তক থা...'কে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন ডিম্পল। মৃত্যুর পরেও জীবন থাকে কিনা জানি না। তবে যদি থাকে, তাহলে দেখা হোক ডিম্পল আর বিক্রমের।।