আমাদের ঈশ্বর হলেন নশ্বর ঈশ্বর। সমাজপতিদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের প্রচলণ করেছিলেন। শিক্ষা বিস্তার, সংস্কার আন্দোলন সব কিছুর পরেও এটাই ছিল বিদ্যাসাগরের অন্যতম বড় কাজ! কিন্তু তার বদলে জুটে ছিল সমালোচনা, কুৎসিত ব্যক্তি আক্রমণ। তদানিন্তন কলকাতায় সং বেরোত তাঁর নামে। লোকেরা অশালীন ইঙ্গিতে ব্যঙ্গবিদ্রুপে বিদ্ধ করত তাঁকে। বিধবাদের বিয়ে দেওয়ার অপরাধে একঘরে করে দেওয়া হয়েছিল বিদ্যাসাগরকে। কিন্তু তিনি ছিলেন অনড়। লক্ষ্যে অবিচল মানুষ। কীভাবে অনড় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি! আমায় বিস্মিত করে। আসলে সব ভাল কাজের জন্য সুখ্যাতি জোটে, কাঁটার মুকুটও পড়তে হয় কখনও কখনও।
কেউ কেউ মারধর, এমন কী খুনের হুমকি পর্যন্ত দিতেন। শুধু হুমকিতেই থেমে থাকল না, বিদ্যাসাগর একবার শুনলেন, তাঁকে খুন করার জন্য সুপারি কিলারকে বরাত দিয়েছিল কলকাতার এক কেউকেটা। বিদ্যাসাগর নিজেই গিয়ে হাজির হয়েছিলেন তার বাড়ি! আসলে মানুষটা ছিলেন নির্ভীক। আবার বাস্তববাদী আবেগী, বাস্তববাদী কারণ নিজেকে লেখক ব্যবসায়ী বলতেন আর আবেগীর কারণটা বঙ্গদেশে এমন কেউ নেই যে জানে না।
ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছেলের চিন্তায় বীরসিংহ থেকে জেলে-সর্দার লেঠেল শ্রীমন্তকে বিদ্যাসাগরের কাছে পাঠিয়েছিলেন। পাহাড়ি সান্যালের বিদ্যাসাগর সিনেমায় এই চরিত্রটি দেখানো হয়েছিলেন। সময়টা ছিল উনবিংশ শতকের শেষার্ধ, ১৮৭২ সাল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখলেন বিষবৃক্ষ। বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী এক সৃষ্টি। ধারাবাহিকভাবে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু হল সেই উপন্যাস। এই উপন্যাসের নায়িকা সূর্যমুখীর মুখ দিয়ে ঔপন্যাসিক বঙ্কিম বলালেন, 'ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে নাকি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবাবিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তবে মূর্খ কে?'
এইভাবেই নিজের কলমকে ব্যবহার করে বিদ্যাসাগরকে আক্রমণ করছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। শুধু তাই নয়, বিধবাবিবাহ প্রবর্তন থেকে শুরু করে বহুবিবাহ বা বাল্যবিবাহ রোধ, বিদ্যাসাগরের প্রতিটি সামাজিক সংস্কারমূলক কাজের বিরোধিতা করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র।
এরপর একবার বিদ্যাসাগর সম্পর্কে, কুমার বিনয়কৃষ্ণ দেবকে লেখা একটি চিঠিতে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, 'শাস্ত্রের দোহাই দিয়া কোনপ্রকার সমাজসংস্কার যে সম্পন্ন হইতে পারে, অথবা সম্পন্ন করা উচিত, আমি এমন বিশ্বাস করি না। যখন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় বহুবিবাহ নিবারণের জন্য শাস্ত্রের সাহায্য গ্রহণ করিয়া আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছিলেন, তখনও আমি এই আপত্তি করিয়াছিলাম এবং সেমত পরিবর্তন করার কোন কারণ দেখি নাই।বাঙালি সমাজ শাস্ত্রের বশীভূত নহে দেশাচার বা লোকাচার বশীভূত।'
এই বিরোধীতা তিনি এতটাই নিম্নস্তরে নামিয়ে এনেছিলেন যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিদ্যাসাগারের অবদানকেও মান্যতা দিতেন না তিনি। বঙ্কিমচন্দ্র কেবল সূর্যমুখীর মুখ দিয়ে বিদ্যাসাগরকে মূর্খ বলেই ছেড়ে দেননি, বরং তাঁকে ব্যক্তি আক্রমণ করতেও পিছপা হতেন না। এই সব আক্রমণ হত বিদ্যাসাগর সৃষ্ট সাহিত্যকে নিয়ে, নানান সমলোচনায় বিদ্ধ করতেন বিদ্যাসাগরের লেখাকে। এমনকি কবি সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্তের থেকেও বিদ্যাসাগর রচিত সাহিত্যকে প্রকাশ্যে নিম্নমানের বলে দাবি করতেন বঙ্কিমচন্দ্র। এই ঈশ্বর গুপ্তও বিদ্যাসাগরকে আক্রমণ করতে ছাড়েনি। সে সময় সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা সম্পাদনা করতেন ইশ্বর গুপ্ত। তীব্র ব্যক্তি আক্রমণ শানিয়ে সংবাদ প্রভাকরে কবি ইশ্বর গুপ্ত লিখলেন-
আমি শুনে এলেম ওদের টোলে, শুনে মন
গেল উতুলে, রাঁড়ের বিয়ের ছাপা নাকি এসেছে।
বুঝি বিদ্যাসাগর এতদিনে, বিধবা নারীগণে,
একলা শোয়ার কত জ্বালা জেনেছে।
ঈশ্বর গুপ্ত আরও লিখেছিলেন, "সাগর যদ্যপি করে সীমালঙ্ঘন,
তবে বুঝি হতে পারে বিবাহ ঘটন।"
১৮৫৫ সালের জানুয়ারী বিদ্যাসাগরের 'বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব' বইটি প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি হট টপিক! সর্বত্র আলোচনা শুরু হল। কেউ পক্ষে, আবার কেউ বা বিরুদ্ধে। ঈশ্বর গুপ্ত লিখে দিলেন,
'বাধিয়াছে দলাদলি লাগিয়াছে গোল। বিধবার বিয়ে হবে বাজিয়াছে ঢোল।।'
শান্তিপুরের তাঁতিরা 'বিদ্যাসাগর পেড়ে' শাড়ি বুনলেন। এই শাড়ির বিক্রিও ছিল মন্দ না, বিদ্যাসাগরের সমর্থনে শাড়ির পাড়ে লেখা হল, 'সুখে থাকুক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে।' তার ফিরতি প্যারোডি বেরুলো, 'শুয়ে থাক বিদ্যাসাগর চিররোগী হয়ে।'
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, এদেশের মানুষ নানান কাজের জন্য তাঁকে মনে রেখেছে। তিনি আজও শ্বাশত, নিজের মতো করে উজ্জ্বল। তাঁর অগুণিত সমাজ সংস্কারমূলক কাজের মধ্যে অন্যতম এক কাজ হল বিধবাবিবাহ প্রবর্তন। সমাজপতিদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের প্রচলণ করেছিলেন। হাজারেরও কম স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিলেন কিন্তু রুখে দাঁড়িয়ে তো ছিলেন। লোকেরা আক্রমণে বিদ্ধ করত তাঁকে। কিন্তু একটি সমালোচনারও পাল্টা উত্তর করতেন না, এটিই তাঁর চরিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। কোনও দিন রাগেননি বিদ্যাসাগর। হয়ত ক্রোধ তাঁকে স্পর্শ করত না। তাই তিনি বিদ্যাসাগর।
একদা বর্ধমানে, তারকনাথ বিশ্বাসের বাড়িতে ভোজসভার আয়োজন করলেন বিদ্যাসাগর, ঠিক করলেন নিজের হাতেই সকলকে রেঁধে খাওয়াবেন। করলেনও তাই, ঐদিনের মেনুতে ছিল পাঁঠার ঝোল আর আম আদা পাঁঠার মেটের অম্ল। নিমন্ত্রিতদের তালিকায় ছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। খেতে খেতে প্রীত হয়ে বঙ্কিমচন্দ্র বলে উঠলেন, 'এমন সুস্বাদু অম্ল তো কখনও খাই নাই।' সেই ভোজসভায় নিমন্ত্রিতদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাই সঞ্জীবচন্দ্রও ছিলেন। তিনি বললেন,'হবে না কেন, রান্নাটা কার জানো তো, বিদ্যাসাগরের।'
বিদ্যাসাগরও হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, বঙ্কিমকে খানিক ঠুকেই, 'না হে না! বঙ্কিমের সূর্যমুখী আমার মতো মুর্খ দেখেনি।' বঙ্কিমচন্দ্র আর কিছুই বলতে পারেননি।
অন্য এক ঘটনা জনৈক এক ভদ্রলোক বঙ্কিমচন্দ্রের নিন্দা করছেন বিদ্যাসাগরের কাছে। বঙ্কিমের চরিত্র নিয়ে ইঙ্গিত করে বলছেন কদর্যভাবে রাত কাটান বঙ্কিম। সব শুনে বিদ্যাসাগর বলে উঠলেন 'বলো কী? সারাদিন এত বড় সরকারি দায়িত্ব পালন করেও এভাবে রাত কাটায়, তাহলে লেখে কখন! আমার তো একটা সেলফ তাঁর বইয়ের ভরে গেল। যাই বল তোমার কথা শুনে বঙ্কিমচন্দ্রেরর প্রতি শ্রদ্ধা আমার বেড়ে গেল।' অথচ বঙ্কিম কিন্তু ইচ্ছে করে বিদ্যাসাগরের সাহিত্যকে উড়িয়ে দিতেন সমালোচনার ঝড়ে।
কিন্তু ঈশ্বর না, কাভি নেহি! এমনই ছিলেন বিদ্যাসাগর। সামাজের উন্নতি করতে গিয়ে, জুটেছে কদর্য ব্যক্তি আক্রমণ। কিন্তু সেসবে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি তিনি। ব্যক্তিগত আক্রমণের জবাবে কখনও পাল্টা আক্রমণ করেননি। আক্রমণের সব শর নিজের বুক পেতে ধারণ করতেন। বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখাতেন না। সারা জীবন সব আঘাতকে নিজের মাথায় কাঁটার মুকুটের মতো ধারণ করেছেন। হয়ে উঠেছেন সাক্ষাত নীলকন্ঠ।
বিদ্যাসাগর অনেকগুলো কলকাতা দেখেছিলেন, গ্রাম থেকে এসে এক কলকাতা দেখেছেন। যে কলকাতা তাকে থাকতে দিয়েছে, পড়তে দিয়েছে, বিদ্যাসাগর গড়ে তুলেছে, উপার্জন দিয়েছে। আবার আরেক কলকাতায় বিদ্যাসাগরকে পোহাতে হয়েছে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, শুনতে হয়েছে অপবাদ, অপমান। বিদ্যাসাগর হয়েও জুটেছে গ্লানি, তাইতো আদিবাসীদের সঙ্গকেই বেছে নিয়েছিলেন। যে কলকাতা তাকে রাজা বানিয়েছিল, সে কলকাতাই তাকে নিয়ে খেউর সং বেঁধে ছিল, একেই বোধহয় সমাপতন বলে।