রঙের খেলায় টোম্যাটোর স্বাদ
ফি বছর আপামর পৃথিবীবাসীর নজরের কেন্দ্রে থাকে স্পেনের এই আনন্দোৎসব ।
সাল ২০১১। তিন বন্ধু ব্যাচেলর ট্রিপে পাড়ি দিল স্পেন। সেখানেই একদিন রাস্তায় লুটোপাটি সকলে। এ ওকে টোম্যাটো মাখাচ্ছে।ছুড়ে মারছে এক অন্যকে। মন কেড়েছিল সেই হিন্দি ছবির দৃশ্য।
স্পেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রীষ্মকালীন উৎসব। বুঁয়্যোল শহরের প্লাজা ডেল পুয়োবলা ।এলাকার মাঝে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে দোতলা সমান উঁচু একটি গ্রীজ মাখা থাম ।
মাথায় ঝুলছে একটি মাংসের বড় টুকরো ।সেটি নামানো মানেই উৎসব শুরুর সবুজ সংকেত।
উত্তাল নাচ-গান আর হোস পাইপ দিয়ে অঝোর ধারায় জল বর্ষণ। স্ফূর্তিতে আট থেকে আশির জলকেলি। ততক্ষণে সারি সারি ট্রাক ভরে এসে গিয়েছে কয়েকশো টন টোম্যাটো ।
উপর থেকে সেগুলো ছুঁড়ে ফেলা হয় রাস্তায়। যেন ফুল বর্ষণ।ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কংক্রিটের রাস্তা হয়ে গেল টোম্যাটোর নদী ।
একে অপরের গায়ে সোল্লাসে টোম্যাটো হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সকলে। হোসপাইপ থেকে জলের কামান দেগে চলতে থাকে স্নান।
লা টোমাটিনা।প্রতি বছর অগস্ট মাসের শেষ বুধবার অনুষ্ঠিত হয় এই টোম্যাটোর হোলি।সকাল ১১ টায় উৎসবের শুভ সূচনা।শহর জুড়ে তখন বৃষ্টিপাত। টোম্যাটোর।
উৎসবের শুরুর ইতিহাসটা বিশেষ রোমাঞ্চকর কিছু নয়। লেগে রয়েছে দুই শিশুর নিস্পাপ হাসির ছলে একটা খেলা।
১৯৪৫ সাল। ভ্যালেন্সিয়া থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বুঁয়্যোল।একটি ছোট্ট গ্রাম।সেখানেই শুরু বর্তমানের অন্যতম চর্চিত এই লা টোমাটিনা৷
কারণ, স্থানীয় কোনও ঐতিহ্য নয়। নিছকই মজার ছলে গ্রামের দুটি বাচ্চার একে অপরকে টোম্যাটো ছোঁড়াছুঁড়ির মধ্য দিয়েই হয় সূত্রপাত ।
বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ১৯৫০ নাগাদ।মনের উৎসবে আইন কি আর বাঁধ সাধে!সাত বছর পর শুরু হল আবার। ২০০২ –এ দেশের সরকার কর্তৃক আন্তর্জাতিক উৎসবের স্বীকৃতি হাসিল।
সেই শুরু। বছরের পর বছর লোকের ভিড় আর থামার নাম নেয়নি। আগে কোনওরকম প্রবেশাধিকার এর বাধ্যবাধকতা না থাকলেও, উপচে পড়া ভিড় সামলানোর দায় এখন টিকেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
টিকেট ছাড়া কিছুতেই উৎসবে অংশ নেওয়া যায় না। প্রতি বছর প্রায় বাইশ হাজার লোককে অনুমতি দেওয়া হয় । টিকিট মূল্য ১০ ইউরো ।
বিনোদনে গা ভাসালেই হবে না। মেনে চলতে হয় বেশ কিছু নিয়ম কানুন।অংশগ্রহনকারীদের বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি হতে হবে। টোম্যাটো ছোঁড়ার আগে অবশ্যই তা ফাটিয়ে নিতে হবে। আস্ত টোম্যাটো মারলে কেউ আঘাত পেতে পারে সেজন্যই এই ব্যবস্থা।
কারও টিশার্ট ধরে টানাটানি করা বা ছেঁড়া যাবে না। বোতল জাতীয় কিছু সঙ্গে আনা যাবে না। নির্দিষ্ট ঘণ্টা বাজার পর ,ঠিক দুপুর ১২ টায় , টোম্যাটো ছোড়া বন্ধ করে দিতে হবে।
উৎসবের পর পরিষ্কারের কাজটাও অংশগ্রহনকারীরাই করে থাকেন। সেও আর এক উৎসব। গ্যালন গ্যালন জল ঢেলে রাস্তা পরিস্কার করে নিজেরা ঝাপিয়ে পড়েন বুঁয়্যোল নদীতে।
সেখানেও দাপাদাপি আর হৈ হুল্লোরের কমতি থাকেনা। চারিদিক জুড়ে পাগলা হাওয়ায় বাদল দিনের রব। মূল উৎসব শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়।
উৎসব উপলক্ষে বুঁয়্যোল শহরের নানা স্থানে বসে গানের আসর, কুচকাওয়াজ, নাচানাচি । আতশবাজি চলে সপ্তাহজুড়ে।গোটা আকাশে সুখের ঘন ঘটা।
কলম্বিয়ার রিকোর্ট প্রভিন্সের ছোট্ট শহর সুতামার্চন। এখানে শুধু টোম্যাটো নষ্ট করার উৎসবই হয় না। চলে টোম্যাটো খাওয়ার প্রতিযোগিতাও । তিন দিন ধরে চলে টোমাটিনা উৎসবের এই নতুন সংস্করণ।
স্পেনের আন্তর্জাতিক উৎসবের রস আস্বাদনে কলম্বিয়াতেও একইভাবে এই উৎসব স্বমহিমায় জনশ্রুতির আকার নিয়েছে।ভারতের আমেদাবাদ শহরও সেই তালিকার নবতম সযোজন।
রঙের উৎসব কে বুক জুড়ে আগলে নিতে আর কয়েকদিনের অপেক্ষা! গোটা দেশ জুড়েই সাজো সাজো রব। শহরের ফুটপাথে রংবাহার আবিরের শামিয়ানা।আসন্ন দোলযাত্রার প্রাক্কালে ভীন দেশের এই অন্য ধারার রঙিন উৎসবকে সাধুবাদ।