চিরনিদ্রায় ভীষ্ম

মানিকের ভীষ্ম চলে গেলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ৭৩ বছর। করোনার থেকে সেরে উঠলেও শেষ রক্ষা হল না। সত্তর-আশির দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের এক শক্তিশালী অপরিহার্য চরিত্রাভিনেতা হয়ে উঠেছিলেন ভীষ্ম গুহঠাকুরতা। তাঁর শিল্পী সত্তা ছিল অতুলনীয়।

দক্ষিণীর প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী শুভ গুহঠাকুরতার পুত্র ছিলেন ভীষ্ম, বাবার মতো তিনি নিজেও খুব ভাল রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারতেন। পিয়ানো বাজাতেও পারদর্শী ছিলেন তিনি। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গানের সঙ্গে পিয়ানো বাজানোর অভিনেতাকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।​ চমৎকার ছবিও আঁকতেন। অবসর যাপনে রং-তুলিতে ডুবে থাকতেন। তরুণ বয়সে ক্রিকেটও খেলেতেন। ক্রিকেটের বাইশ গজ থেকে রুপোলি পর্দায় এসে পড়েছিলেন ভীষ্ম। যদিও শুরুটা হয়েছিল মঞ্চ থেকে, দীর্ঘদিন নাটকের মঞ্চ কাঁপিয়ে ছিলেন তিনি। দক্ষিণীর প্রযোজনায় 'নষ্টনীড়' নাটকে অভিনয় করার সুবাদে ক্রিকেটের ড্রেসিংরুম থেকে মঞ্চে চলে আসেন।

নাটকে তাঁর অভিনয় দেখে প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক তপন সিংহ তাঁকে প্রথম 'রাজা' ছবিতে সুযোগ দেন। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর তপন সিংহের পরিচালনায় একের পর এক ছবিতে কাজ করে গিয়েছেন। যার মধ্যে হারমোনিয়াম, আতঙ্ক, অন্তর্ধান, বৈদুর্য রহস্য,  আদালত ও একটি মেয়ে, বাঞ্ছারামের বাগান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বৈদুর্য রহস্যে মনোজ মিত্রের সহকারী গোয়েন্দা চরিত্রে তাকে দেখা গিয়েছিল। রহস্য গল্পেও নামিয়ে এনেছিলেন কমিক রিলিফ। 'আতঙ্ক' ছবিতে সুমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ডান হাত হিসেবে দর্শক এবং সমালোচক মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। অন্তর্ধান ছবিতে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয় দর্শকদের নজর কেড়েছিল। ভীষ্মের কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা কাজ হয়ে থাকবে বাঞ্চারামের বাগানের গুপী চরিত্রটি।

সত্যজিতের ছবিতেও তিনি ছিলেন স্বপ্রতিভ, সত্যজিতে তাঁর মামা এবং মামাতো ভাই হলেন সন্দীপ। রায় বাড়ির বাপ-ব্যাটার পরিচালনায় একাধিক ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন ভীষ্ম। ফটিকচাঁদ ছবি থেকে সত্যজিতের ছবিতে হাতেখড়ি হয় ভীষ্মের। সত্যজিতের গণশত্রু, শাখা-প্রশাখাতেও তাঁর অভিনয় চোখে পড়ার মতো। গণশত্রুতে মমতা শঙ্করের বিপরীতে তাঁকে দেখা গিয়েছিল। গুপী বাঘা সিরিজের তৃতীয় ছবিতে অর্থাৎ সন্দীপের গুপী বাঘা ফিরে এলো ছবিতে বিক্রমের বাবা তথা এক গ্রামের স্কুল মাস্টারের চরিত্রে ভীষ্ম গুহঠাকুরতাকে দেখা গিয়েছিল।

শিল্পের যাপনে দিনযাপনকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। কোনদিন নায়ক হওয়ার চেষ্টা করেননি তিনি, কেবল চরিত্রাভিনেতার গন্ডিতেই বেঁধে রেখেছিলেন নিজেকে। গত শতকের শেষার্ধে পর্দায় যাদের বৌদ্ধিক অভিনয় শিক্ষিত বাঙালি দর্শকদের মুগ্ধ করত, তাদের একজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বিখ্যাত পরিচালকদের অসামান্য চরিত্রাভিনেতা ভীষ্ম গতকাল দিক শূন্যপুরের স্থায়ী ঠিকানায় বাড়ি বদলালেন।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...