‘চুরি’ করতে গিয়ে জীবনের মোড় ঘুরে গেল হরি সাধক রামানন্দ স্বামীর!

চুরি করাকে আমরা গর্হিত কাজ বলে মনে করি, কিন্তু চুরি করতে গিয়েই জীবন বদলে গিয়েছিল এক ছোট্ট বালকের, তিনি হলেন বৈষ্ণব সাধক রামানন্দ স্বামী। একদিন গুরুদেবের ভোরবেলার পুজোর জন্য পাঁচগঙ্গা মহল্লার প্রাচীর ঘেরা বাগানে ফুল তুলতে গিয়েছিল বালক রামদত্ত। সেই আশ্রমের অধ্যক্ষ তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি আশ্রমে ফুল চুরি করতে এসেছ কেন? এর উত্তরে বালক রামদত্ত বলেছিলেন," চুরি! কী বলছেন আপনি? দেবপূজার জন্য কয়েকটা ফুল নিয়েছি-একে চুরি বলে? " অধ্যক্ষ তখন বলেন চুরি করে আবার তার সমর্থনে সাফাই গাইছ? সামনে এগিয়ে এস!-বালক সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পায়, ইনি রামানুজ সম্প্রদায়ের অগ্রণী আচার্য স্বামী রাঘবানন্দ। অন্যদিকে বালক রামদত্তের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠেন রাঘবানন্দ!

বালকের ভবিষ্যৎ দেখে তিনি চমকে ওঠেন! এই বালকের আয়ু আর মাত্র সামান্য কয়দিন! তিনি রাম দত্তকে বলেন, তুমি তোমার আচার্যকে গিয়ে বল আজই যেন তিনি আমার সঙ্গে দেখা করেন। রাম দত্ত সেই সংবাদ তার শিক্ষা গুরুকে দেন, রাম দত্তের স্বল্পায়ুর কথা আগে থেকেই জানতেন রামদত্তের গুরুদেব , তাই রাম দত্তকে তিনি রাঘবানন্দ স্বামীর কাছে সঁপে দিলেন। এরপর শুভ দিনে দীক্ষা হয়ে গেল রাম দত্তের, তার নতুন নাম হল রামানন্দ স্বামী। দীক্ষার কয়েকদিনের মধ্যেই রামানন্দের জীবনে এগিয়ে আসে সেই নির্ধারিত মৃত্যু তিথি কিন্তু গুরু রাঘবানন্দ তার অসামান্য যোগ শক্তির বলে রামানন্দের মৃত্যুকে প্রতিহত করেন, আসলে যার জন্মই হয়েছে সাধনাতে লীন হওয়ার জন্য, সমাজকে সংস্কার করার জন্য তার অকাল মৃত্যু টলে যাওয়াই ছিল বিধাতার ইচ্ছা তাই মৃত্যুকে জয় করে রামানন্দ আত্মিক সাধনার কঠিন পথে অগ্রসর হতে শুরু করলেন। এরপর গুরুর আদেশেই বেরিয়ে পড়লেন তীর্থ ভ্রমণে।

কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা, গুজরাট থেকে গঙ্গাসাগর পরিভ্রমণ করেন রামানন্দ স্বামী। এরপর গঙ্গা নদীর মোহনায় গঙ্গাসাগর তীর্থে গিয়ে তিনি দিব্যভাবে আবিষ্ট হয়ে পড়েন। এই ভাবাবেশের মধ্যেই সেখানকার সাগর উপকূলে তিনি কপিলমুনির প্রাচীন সাধনপীঠ আবিষ্কার করেন। সেখানেই স্থানীয় মানুষজনের সাহায্যে গড়ে উঠেছিল এক ক্ষুদ্র মন্দির, কালের নিয়মে আজ সেই মন্দির লক্ষ লক্ষ ভক্তের কাছে তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে।

ভগবানকে লাভ করবার জন্য রামানন্দ স্বামী সহজতম পথের কথা বলেছিলেন। তিনি শ্রী ভগবানের নাম জপ করার ওপরেই জোর দিয়েছেন বরাবর। তিনি তার ভক্তদের বলতেন, "ভগবানের নাম মন্ত্র নিরন্তর জপ কর, তাতেই ঘটবে পরম মুক্তি, সিদ্ধ হবে সর্ব অভীষ্ট।" তার ভক্তদের উদ্দেশ্যে তার বক্তব্য ছিল সমাজ ও ধর্মাচরণের অনাবশ্যক আচার নিয়ম থেকে মুক্ত হয়ে তারা যেন ভগবানের নাম জপ করেন। এই কারণেই রামানন্দ স্বামীর শিষ্যরা সাধু সমাজে অবধূত বা সর্বপাশমুক্ত সাধক রূপে পরিচিত হতেন, কারণ তারা ধর্মাচরণের অনাবশ্যক আচার নিয়মের মধ্যে নিজেদের পরিব্যাপ্ত করে রাখতেন না।

রামানন্দ স্বামীর উপাস্য ছিলেন ভগবান শ্রী রামচন্দ্র। তবে তিনি তার ভগবত প্রেমের প্রচার শুধু বৈষ্ণবগণ নয়, ব্রাহ্মণ থেকে শুরু করে আব্রাহ্মণদের মধ্যেও অকাতরে প্রচার করেছেন। রামানন্দ স্বামী বলতেন, হরিকে যে করবে ভজন, সেই হবে হরির আত্মজন। সাধক রামানন্দের সাধনা ও দার্শনিক তত্ত্বের মূল কথা আসলে ছিল ভগবত প্রেম। পুরুষ হোক বা নারী, ব্রাহ্মণ হোক বা অন্ত্যজ ভগবানের দৃষ্টিতে তারা সকলেই সমান এমনটাই মনে করতেন সাধক রামানন্দ। সেই কারণেই রামানন্দী সম্প্রদায়ে সকলকেই সমান অধিকার দেওয়া হয়েছিল। রামানন্দ স্বামী ই রামাওয়াৎ পন্থীদের সাধনার ধন। এখনও রামাওয়াৎ সম্প্রদায়ের প্রচলিত প্রথার অনুসরণে উত্তর ভারতের জনসাধারণ একে অপরকে দেখলে 'জয়রাম' বা সীয়ারাম অথবা রামরাম বলে অভিবাদন করে সৌজন্য প্রকাশ করেন।

রামানন্দ স্বামীর পুরুষ শিষ্যদের মধ্যে মুসলমান কবীর অন্যতম। তার স্ত্রী শিষ্যদের মধ্যে পদ্মাবতী ও সুরেশ্বরীর নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া এক রাজপুত বংশীয় রাজা পিপাজী রামানন্দ স্বামীর শিষ্যত্ব লাভ করতে ছুটে এসেছিলেন। রাজকার্য ও বিলাসব্যসন নিয়ে মত্ত থাকলেও তার অন্তরে ছিল গভীর আধ্যাত্ম রস। তাই একদিন সেই রাজা যখন তার কুলদেবীর প্রত্যাদেশ পেলেন,তখন তিনি কাশীধামে রামানন্দ স্বামীর কাছে ছুটলেন দীক্ষা নিতে। কিন্তু রামানন্দ দীক্ষা দিতে রাজি নন, শাক্ত বংশীয় রাজা যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে ব্যস্ত থাকে সে ভক্তির রাজ্যে মন স্থির রাখতে পারবে না বলেই ফিরিয়ে দিতে চাইলেন রামানন্দ স্বামী। পিপাজী বললেন, ভক্তির পরীক্ষা দিতে তিনি প্রস্তুত, গুরুর আদেশে তিনি প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারেন, রামানন্দ স্বামী একটি সুগভীর কূপ দেখিয়ে তাকে মৃত্যুবরণ করতে বললে এতটুকু দ্বিধা না করে পিপাজী কুয়োর কাছে ছুটে যান, ঝাঁপ দেওয়ার আগের মুহূর্তে রামানন্দ স্বামীই তাকে আটকান ও দীক্ষা দিতে রাজি হন। তবে রামানন্দ স্বামীর আদেশে দীক্ষা গ্রহণের আগে এক বছর আশ্রমে বাস করে কঠোর তপস্যা করেন পিপাজী। এরপর রানীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি দীক্ষা গ্রহণ করেন, দীক্ষার পর পিপাজীর নতুন নাম হয় পিপানন্দ।

রামানন্দ স্বামী একাধিক শাস্ত্র ও গ্রন্থ রচনা করেছিলেন আর যোগসিদ্ধির বলে শতাধিক বর্ষ অতিক্রম করেন। তার জন্ম হয়েছিল ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াগের কাছে মালকোটে আর ১১১ বছর বয়সে ১৪১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইহলীলা ত্যাগ করেন। যোগসিদ্ধির বলে স্বল্পায়ু এক বালক হয়ে ওঠেন বৈষ্ণব সাধক, অতিক্রম করেন শত বর্ষ আয়ুকে, তার জীবন সকলকে এই শিক্ষা দেয় যে, সাধনার মাধ্যমে, ভগবানকে প্রসন্ন করার মাধ্যমে নিয়তিরও বদল ঘটানো সম্ভব। শ্রী সারদা মা যেমন বলেছিলেন ভগবান প্রসন্ন হলে, তাকে নিরন্তর এক মনে ডাকলে তিনি কপালের রেখা নিজে হাতে মুছে দেন, সাধক রামানন্দের জীবন যেন সেই কথাকেই প্রতিষ্ঠিত করে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...