আজ ভাইফোঁটা, পিতল-কাঁসার থালায় ঘি, চন্দন, দই ও কাজল বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে তুলে শিশির দিয়ে ভাইয়ের কপাল মুছিয়ে দিয়ে, ধান-দূর্বা দিয়ে শাঁখ বাজিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে ফোঁটা দেবেন বোন-দিদিরা। চিরাচরিত ছড়া বলা হবে,
'ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা
যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা
আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা...'।
অঞ্চলভেদে ছড়ার কিছু অদলবদলও চোখে পড়ে। ভাইয়ের মঙ্গলকামনায় অজস্র ব্রত রয়েছে বঙ্গে। তবে এই দ্বিতীয় তিথিটি অনন্য।কালীপুজোর ঠিক দু-দিন পর কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথির দিন এই উৎসব পালিত হয়। উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি অঞ্চল, যেমন দার্জিলিং, কার্শিয়াংয়ে এটি 'ভাইটিকা' নামে পরিচিত। পশ্চিম ভারতে ভাই দুজ, মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কর্ণাটকে ভাইবিজ নামেও পরিচিত। এই উৎসবের আরেকটি নাম 'যমদ্বিতীয়া'। তবে যম আর তাঁর বোনের ভাতৃদ্বিতীয়া নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। কেউ বলেন বেদে বা পুরাণে বোনের হাতে যমের ভাইফোঁটা নেওয়ার কথা নেই। যমের বোন যমী নাকি যমকে ভাইফোঁটা দেননি! আবার তাঁদের স্বামী-স্ত্রীও মনে করা হয়। কথিত আছে সূর্যদেব ও সংজ্ঞার যমুনা নামে কন্যা এবং যম নামে পুত্র সন্তান ছিল। যমুনা স্বর্গরাজ্য থেকে বিতারিত হয়। যমুনার বিয়ে হয়। দীর্ঘকাল পর দিদিকে দেখার জন্য কালীপুজোর দুদিন পরে অর্থাৎ ভাতৃদ্বিতীয়ার দিন যম যমুনার বাড়ি যাত্রা করে।সেই থেকেই উৎসবের শুরু।
আবার অন্য মতে, নরকাসুর বধের পর কৃষ্ণ সুভদ্রার কাছে আসেন, তখন সুভদ্রা তাঁর কপালে ফোঁটা দিয়ে তাঁকে মিষ্টি খেতে দেন। সেই থেকে ভাইফোঁটা উৎসবের প্রচলন হয়। পৌরাণিক ইতিহাস আবার বলছে, বলির হাতে বিষ্ণু পাতালে বন্দি হন। শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করেন লক্ষ্মী। বলিকে তিনি ভাই ডেকে কপালে তিলক এঁকে দেন। বলি লক্ষ্মীকে উপহার দিতে চাইলে লক্ষ্মী ভগবান বিষ্ণুকে চেয়ে নেন। সেই থেকেই ভাইফোঁটার সূত্রপাত।
বঙ্গদেশে ভাইফোঁটার সূত্রপাত ঠিক কতদিন আগে হয়েছিল, তা নিয়ে সর্বানন্দ সুন্দরী নামের এক তালপাতার পুঁথিতে বিবরণ মেলে। খ্রিস্টপূর্ব ৫২৭ অব্দে এই প্রথা চালু হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে মহাবীর জৈনের প্রয়াণে রাজা নন্দিত বর্ধনের শোকবিহ্বল ভগিনীকে সান্ত্বনা দিতে অন্নগ্রহণ করানো হয়। সেই থেকে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার প্রথা চালু হয়। আবার অনেক পরিবারে প্রতিপদেও ফোঁটা দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। একান্নবর্তী পরিবারগুলির অন্যতম পার্বণ ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। যদিও আজ তা অনেকটাই ম্লান।
তবে যম দুয়ারে পড়ল কাঁটা ছাড়াও অন্য ছড়াও মিশে রয়েছে লোকাচারে। ''ভ্রাতস্তবানুজাতাহং ভুঙক্ষভক্তমিদং শুভম্। প্রীতয়ে যমরাজস্য যমুনায়া বিশেষতঃ।'' বোন ভাইয়ের অগ্রজ হলে, অর্থাৎ দিদি হলে শব্দটা হয় 'ভ্রাতস্তবাগ্রজাতাহং'।''
পূর্ববঙ্গে ভাইফোঁটার গানও রয়েছে। বোনের বিয়ে হয়ে গেলে প্রতিপদে ফোঁটা দেওয়া হয়, ওপার বাংলা নদীমাতৃক দেশ। বর্ষায় নদী ফুলেফেঁপে একাকার, যাতায়াতের ভরসা কেবল নৌকা। তাই ফোঁটা নিয়ে দিনের দিন এসে ফিরে যাওয়া ছিল কার্যত অসম্ভব। তাই আগের দিন ভাইদের ফোঁটা দিয়ে লোকাচারের সেরে রাখতেন বোনেরা। পরদিন শুধু খাওয়া দাওয়া চলত। তারপর ভাই রওনা ছিল।
পূর্ববাংলার কোনও কোনও অঞ্চলে ভাইফোঁটা উপলক্ষ্যে গান গাওয়ার প্রচলন ছিল। মেয়েলী গানগুলোর মাধ্যমে ভাই-বোনের সম্পর্ক ফুটে উঠত। একেবারে গ্রাম্য গান, শব্দের ব্যবহারে পরিপাটি নেই। কিন্তু পুরোদস্তুর আন্তরিকতার বুনোট। গানটি-
আশ্বিন যায় কাতিক আইয়ে গো।
দবিতীয়ার চান্দে দিল দেখা ॥
ভাই-দ্বিতীয়ার দিলাম ফোঁটা।
ওরে ওরে করুয়াল, তুই সহরে যাইতে।
ভাই-ফোঁটা কথা শুনতাম গোবর আন্যা দিতে॥
ওরে ওরে করুয়াল, তুই সহরে যাইতে।
ভাই-ফোঁটা কথা শুনতাম মেথী আন্যা দিতে॥
ওরে ওরে করুয়াল, তুই সহরে যাইতে।
ভাই-ফোঁটা কথা শুনতাম আগ্রী আন্যা দিতে॥
গানটির আরেক রূপভেদ পাওয়া যায়।-
আশ্বিন যায় কাতিক আইতে গো।
ভাইধনেরে দুতিয়া দিব রঙ্গে॥
পাড়ারি ডাকাইয়া ভইনে রঙ্গী গুয়া পাড়িল গো।
ভাইধনের দুতিয়া দিব রঙ্গে।
বারুইয়া ডাকিয়া ভইনে ঝারি পান কিনিল গো,
ভাইধনের দুতিয়া দিব রঙ্গে॥
কেমন গৌরব যোগী ভইনের-ভাইধন বসিল গো,
ভইনের ধোয়া চন্দন হইয়া গেল বাসি গো॥
কাপইড়া ডাকাইয়া ভইনে ক্ষীরুয়া জোড়া কিনিল গো,
ভাইধনেরে দুতিয়া দিব রঙ্গে॥