উত্থান দ্বাদশী ব্রত যে-কারণে ভক্তজন অবশ্যই পালন করেন

‘শুক্লে কার্ত্তিকমাসস্য দ্বাদশ্যাং পরমোৎসব’। অর্থাৎ, কার্তিকের শুক্লা দ্বাদশীর ব্রত-উৎসবই হল পরম উৎসব। কথাটি বলা হয়েছে আমাদের আঠেরো পুরাণের অন্যতম ‘স্কন্দ পুরাণ’-এর বিষ্ণু খণ্ডের তেত্রিশতম অধ্যায়ের পঁয়তাল্লিশতম শ্লোকে। এখানে কেন এই দিনটিকে এত গুরুত্ব দেওয়া হল, ব্রত-পার্বণের মধ্যে হিন্দুদের কাছে এই দিনটি কেনই বা এত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়; তাই-ই আমরা পুরাণের প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা করবো।

কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বাদশীকে বলা হয়, ‘উত্থান দ্বাদশী’ বা ‘প্রবোধিনী দ্বাদশী’। কার উত্থান? কীসের প্রবোধ? ‘উত্থান’ অর্থাৎ ‘ওঠা’। কোন অবস্থা থেকে ওঠা? নিদ্রা থেকে জাগরিত হয়ে ওঠা। কে উঠছেন? উঠছেন ভগবান বিষ্ণু। উঠছেন, জগত-সংসারকে প্রবোধ দিয়ে মঙ্গলের পথ প্রশস্ত করতে। আসলে, ভগবান বিষ্ণুর নিদ্রা, পার্শ্ব-পরিবর্তন, জাগরণ—সব কিছুই জগতের মঙ্গলকে মাথায় রেখে। তাই এ-সবই আমরা অত্যন্ত ভক্তিসহকারে ব্রত-পার্বণ হিসেবে পালন করি। ‘উত্থান দ্বাদশী’ তারই একটি।

ভগবান বিষ্ণু আষাঢ় মাসের ‘প্রথমা একাদশী’তে যোগনিদ্রায় লীন হয়েছিলেন। জেগে উঠেছেন চার মাস পর, কার্তিকের ‘উত্থান একাদশী’তে। পরের দিন দ্বাদশী। এ-দিন ভক্তজনের কাছে বিশেষ, কেননা, এ-দিন ভগবান বিষ্ণু বিবাহ করেছিলেন তুলসীকে। তাই সমগ্র ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের হিন্দুসম্প্রদায়ের মানুষের কাছে এই দিনটি ‘তুলসী-দামোদর বিবাহ’ দিবস। দক্ষিণ ভারতে আগের দিন থেকে বিধিমতে উপবাস পালন করে সকালে স্নান করে গৃহস্থ তুলসীমঞ্চের তুলসীগাছটিকে ফুল ও মালা দিয়ে এ-দিন সুসজ্জিত করেন; তারপর তার পাশে স্থাপন করেন ভগবান বিষ্ণুর প্রস্তররূপ সুসজ্জিত শালগ্রাম শিলাকে। তারপর পুরুত ডেকে যথাবিধি মন্ত্র সহকারে তুলসী ও শালগ্রাম শিলার বিবাহকর্ম সম্পন্ন করান। সন্ধ্যেবেলায় তুলসী ও দামোদরের একত্রে আরতি হয়। এতে সমস্ত এয়োরা যোগ দেন। পান, ফল, নারকেল ও দক্ষিণা দিয়ে পুজো দেন। সুতরাং, ‘উত্থান দ্বাদশী’ হল ভক্তজনের কাছে তাঁদের ইষ্ট তুলসী-দামোদর(বিষ্ণু)-এর প্রতীকী বিবাহ উদযাপনের দিন।

কিংবদন্তি অনুসারে দেবাসুরের সম্মিলিত প্রয়াসে সমুদ্র মন্থনের সময় তুলসীর আবির্ভাব হয়েছিল। দিনটা ছিল কার্তিকের শুক্লা দ্বাদশী, ধ্বন্বন্তরী অমৃতকুম্ভ নিয়ে উঠে আসার ঠিক আগে সমদ্রগর্ভ থেকে উঠে এসেছিলেন তুলসী। সরাসরি বিষ্ণুর কাছে এসে তাঁকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন; চেয়েছিলেন চিরকাল তাঁর সাথে একাত্ম হয়ে থাকতে। বিষ্ণু তৎক্ষণাৎ তাঁর দ্বিতীয় ইচ্ছা পূর্ণ করেন। বর দেন যে, তুলসীর পাতা ছাড়া বিষ্ণুর পুজো কখনই সম্পন্ন হবে না। তুলসীর সমস্ত অঙ্গে তিনি সর্বদা বিরাজ করবেন। তাই ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, সেই সময় থেকেই তুলসী গাছে ভগবান শ্রীহরি সদা জাগ্রত হয়ে বিরাজমান। ফলে জাগ্রত ইষ্টকে ঘরে স্থাপন করার জন্যই এই সময় থেকেই আপামর ভক্তজনের উঠোনে তুলসীগাছ ও তুলসীমঞ্চ প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত ঘটে। গড়ে ওঠে তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালানোর রীতি। যাই হোক, তুলসী ছাড়া অর্থাৎ তুলসীর বরপ্রার্থনা ছাড়া এই সুকৃতি অর্জনের সুযোগ গৃহস্থের হত না; তাই গৃহস্থ তুলসীকে খুব শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে রেখেছেন আজও। এই সঙ্গে, ভক্তজন এটাও বিশ্বাস করেন যে, ভগবান বিষ্ণু ও তুলসী যেভাবে একদেহে লীন হয়ে আছেন; স্বামী-স্ত্রী ছাড়া সেটা সম্ভব হত না। তাই তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, তুলসী ও বিষ্ণু আসলে স্বামী-স্ত্রী; তুলসীর প্রথম ইচ্ছে পূর্ণ করতে ভগবান বিষ্ণু তাঁকে বিবাহও করেছিলেন। এবং তুলসীর আবির্ভাব ও কৃপাপ্রাপ্তির এই দিনই তাঁদের কাছে উভয়ের বিবাহের দিন।

আবার ‘দেবী ভাগবত’ পুরাণ অনুসারে তুলসীর গাছে বিরাজ করেন স্বয়ং দেবী লক্ষ্মী। আসলে, তুলসী পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন এক অপূর্ব সুন্দরী মানবীরূপে। তাঁকে শঙ্খচূড় নামের এক দৈত্য বিবাহের জন্য জোরপূর্বক হরণ করে। তুলসী কিন্তু ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত। তাঁকেই স্বামী হিসেবে পাবার জন্য তপস্যা করছিলেন তিনি। তুলসীর আকুল প্রার্থনায় ভগবান বিষ্ণু শঙ্খচূড়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যা করে তুলসীকে উদ্ধার করেন। তারপর তুলসীর ইচ্ছে পূরণ করতে তাঁকে বিবাহ করেন। এই সময় তুলসীর সুকৃতিতে তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু তাঁকে বর দেন যে, চিরকাল তুলসীর মধ্যে দেবী লক্ষ্মী বিরাজ করবেন। এরপর ঘটনাক্রমে তুলসী পবিত্র গাছে পরিণত হন; আর বিষ্ণু পরিণত হন শালগ্রাম শিলায়। ভক্তদের বিশ্বাস, এই বিবাহাদি এসব ঘটনা ঘটে কার্তিকের শুক্লা দ্বাদশী তিথিতে। তাই এই দিনটি ভক্তজন তুলসী ও বিষ্ণুর বিবাহ উৎসবের মধ্য দিয়েই পালন করেন।

‘স্কন্দ পুরাণ’-এর ‘বিষ্ণু খণ্ডে’ সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে, কীভাবে এই দিনটি পালন করতে হবে। সেই পৌরাণিকবিধিই এখন সহজভাবে আপনাদের কাছে উপস্থিত করছিঃ

‘স্কন্দ পুরাণ’-এ স্পষ্টই বলা হয়েছে যে, দ্বাদশী হল পুণ্যদায়িনী ও পাপনাশিনী তিথি। তাই দ্বাদশী ব্রত করলে দান, তপস্যা, উপবাস প্রভৃতির যে পুণ্য, সমস্তই অর্জিত হয়। এ-দিন অন্তত একজন ব্রাহ্মণকে ভোজন করাতে হয়। এ-দিন শালগ্রাম শিলা দান করলে অত্যন্ত পুণ্যলাভ হয়। যিনি এ-দিন পঞ্চামৃত (মধু, গুড়, দুধ, দই ও ঘি) দিয়ে ভগবান বিষ্ণুকে স্নান করান, তিনি বিষ্ণুলোক লাভ করেন। ব্রতী সকাল থেকে দান-ধ্যানের মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপন করবেন। সূপনৈবেদ্য দিয়ে দামোদরের পূজা করবেন।

সকালে বিধিমতে দামোদরের পুজো করে সন্ধ্যাবেলায় তুলসীমঞ্চ ধ্বজা, ফুল, মালা প্রভৃতি দিয়ে মণ্ডপের মতো করে সুসজ্জিত করতে হবে। তারপর সেই মণ্ডপের তলায় বসে ভক্তিভরে দামোদর-বিষ্ণুর পূজা করতে হবে। নৈবেদ্য হিসেবে সুগন্ধীজল, ননী, দই, ক্ষীর, ঘন ঘি এবং লবঙ্গযুক্ত পান নিবেদন করতে হবে। তুলসী পাতা, আমলকি ফল ও নানান সুগন্ধী পুষ্পে পূজা করতে হবে। ইষ্টের পূজা বিধিমতে সম্পন্ন করার পর বৃদ্ধ বাবা-মাকে পূজা করতে হবে। তারপর ব্রতী বিষ্ণুপ্রসাদ ভোজন করে ব্রতভঙ্গ করবেন।

পৌরাণিককালে এভাবে উত্থান দ্বাদশী ব্রত উদযাপন করে ব্রতভঙ্গের সময় রাজা অম্বরীষ মহর্ষি দুর্বাসার কূটছলনার শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু প্রকৃতভক্ত অম্বরীষকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। আপন মহাস্ত্র সুদর্শনের ওপর ন্যস্ত করেছিলেন ভক্তের সুরক্ষার ভার। এবং পরিশেষে ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় ভীত দুর্বাসা পরমভক্ত অম্বরীষের কাছে পরাভব স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অন্তিমে ইষ্টের ইচ্ছায় অম্বরীষ মোক্ষ লাভ করেছিলেন।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...