মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং উত্তম কুমার, একজন গায়ক আরেক জন মহানায়ক। বাংলা চলচ্চিত্র তাঁদের দুজনকে একাধিকবার মিলিয়ে দিয়েছে। কখন উত্তমের কণ্ঠ হয়ে উঠেছেন তিনি, নেপথ্যে গেয়েছেন মহানায়কের হয়ে। আবার কখন মহানায়কের সঙ্গে স্ক্রিনও ভাগ করে নিয়েছেন।
১৯৫৩ সালে পরিচালক নির্মল দে তৈরি করলেন সাড়ে চুয়াত্তর। তৈরি হল রুপোলি পর্দার হার্টথ্রব, উত্তম-সুচিত্রা জুটি। এই ছবির গল্পে উল্লেখিত বোর্ডিং-এর অন্যতম একজন বোর্ডারের ভূমিকায় দেখা গেল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে। ভানু-জহর-শ্যামল মিত্রের সঙ্গে তিনিও স্ক্রিন ভাগ করলেন।
কে বা সেই বিনোদিনী...মেসের হইহুল্লোড় করা গান, আজও বাঙালীর মেসের স্মৃতিকে উসকে দেয়। ওই গানের দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন মানবেন্দ্র। ওই ছবিতে ছোট্ট একটু আহির ভৈরো আলাপ গেয়েছিলেন তিনি। যা পরিচালকের ভারী পছন্দ হয়েছিল। তখন থেকেই নির্মলবাবুর নেকনজরে পৌঁছে গিয়েছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
১৯৫৪-এ নির্মল দে বানাচ্ছেন, তারাশঙ্করের গল্প অবলম্বনে চাঁপাডাঙার বউ। সেই ছবিতেই সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে পথ চলা শুরু করলেন মানবেন্দ্র। ছবিতে নায়কের ভূমিকায় ছিলেন মহানায়ক উত্তম কুমার। কিন্তু সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে মানবেন্দ্রর ডেবিউ খুব একটা সোজা ছিল না। রীতিমতো সাহিত্যিকের বাউন্সার সামলে, তিনি টিকে গিয়েছিলেন।
কিন্তু সে বাউন্সার এত সুন্দর সামলেছিলেন, যে তারাশঙ্করের সঙ্গে পরবর্তীতে তাঁর ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ‘চাঁপাডাঙার বউ’-এর পরিচালক নির্মল দে নিজেই একদিন মানবেন্দ্রকে বললেন, 'ছবিতে কাজ হতে পারে। কিন্তু তার আগে পরীক্ষা দিতে হবে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে।’
ততদিনে কয়েকটি প্লেব্যাক করে, নাম করে ফেলেছেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।পরিচালক আর পাকা কথা না হওয়া সঙ্গীত পরিচালক, গেলেন তারাশঙ্করের টালা পার্কের বাড়ি। তখন ব্যাঘ্রচর্মের ওপরে লাল ধুতি পরে বসে লিখছেন তারাশঙ্কর। গলায় উপবীত, রুদ্রাক্ষ।
প্রাথমিক আলাপ পর্ব মিটলে, কথা পাড়তেই মাথা না তুলেই নির্মলবাবুকে তারাশঙ্কর বলে বসলেন, ‘না, না হবে না। গল্পটা আমার খুব শক্ত। স্ক্রিপ্ট আমিই লিখছি। তুমি কোনো পাকা সঙ্গীত পরিচালককে আনো।’ এরপর আর কোনো কথা নেই, এক্কেবারে নিস্তব্ধতা। কিছুক্ষণ বাদে নিজেই বলে উঠলেন, ‘আচ্ছা, দু'কলম লিখে দিচ্ছি। সুর করো তো।’
মানবেন্দ্র বললেন, ‘কিন্তু সিচ্যুয়েশনটা কী?’
তরুণ এবং নবীন সঙ্গীত পরিচালকের একথা শুনেই প্রথমে থমকে গিয়েছিলেন তারাশঙ্কর। মুখে গম্ভীর কন্ঠে শুধু বললেন, ‘মহাতাপ (অর্থাৎ যে ভূমিকায় উত্তমকুমার অভিনয় করেছিলেন) গাজনে শিব সেজে নৃত্য করছে।’ গানের কথা - ‘শিব হে/অশিব শঙ্কর…।’ এরপরেই ঢাকের তালে কীর্তনের সুরে দাঁড়িয়ে উঠে গাইতে শুরু করলেন মানবেন্দ্র।
কিছুক্ষণ বাদেই দেখলেন তারাশঙ্করও উঠে পড়েছেন এবং মুখে তাঁর তৃপ্তির হাসি। গান শেষ হতেই নির্মল বাবুকে বললেন, ‘‘একদম ঠিক জনকেই এনেছ। এইই পারবে। আর কারো খোঁজ লাগবে না।’’
উত্তম কুমারের সঙ্গে অবশ্য অনেক আগে থেকেই মানবেন্দ্রর আলাপ ছিল। একদা তিনিই ছিলেন মহানায়কের তবলা শিক্ষক।তদানিন্তন টালিগঞ্জের বাঙাল পাড়ায় মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছেই তবলা শিখতে যেতেন অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়, আমাদের সকলের প্রিয় উত্তম কুমার।
১৯৬৩ সালে সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায় বানাচ্ছিলেন দেয়া নেয়া। কালজয়ী এই ছবিতে নামভূমিকায় ছিলেন উত্তম কুমার ও তনুজা। আদ্যপান্ত গাননির্ভর এই ছবি। বাংলা সঙ্গীতের শ্রোতাদের এই ছবি উপহার দিয়েছে দুই পুরুষ কণ্ঠের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুগলবন্দী। যা কালোত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। মনে পড়ে সেই গান, দোলে দোদুল দোলে ঝুলনা...। এই গানের রেকর্ডিং-এর আগে মহড়া চলছে।
পরিচালক মানবেন্দ্রকে বলে বসলেন, "আপনাকে একটু খারাপ করে গাইতে হবে।’’ পরিচালকের এহেন কথায় আকাশ থেকে পড়েছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। সঙ্গীত পরিচালক শ্যামল মিত্র আছেন, ইউনিটের অন্যরাও উপস্থিত। মানবেন্দ্র বলে উঠলেন, "মানে! কেন? কী বলছেন আপনি!’’
পরিচালকের যুক্তি, ‘‘আসলে ছবিতে নায়ক (অর্থাৎ উত্তমকুমার) গান জানেন কিন্তু তাঁর বন্ধু (যে ভূমিকায় ছিলেন তরুণকুমার) গান করতে পারেন না। গল্পে এমনই বলা রয়েছে। নায়কের গানটা শ্যামলবাবুর। আপনি গাইছেন বন্ধুর লিপে।’’
মানবেন্দ্র হয়তো বিরক্ত হয়েই বলেছিলেন,"তা বলে খারাপ করে গাইতে হবে! তা হলে আমাকে ডেকেছেন কেন? আমায় বরং ছেড়ে দিন।’’ উঠে পড়ছিলেন মানবেন্দ্র, তখনই প্রবেশ করলেন মহানায়ক উত্তমকুমারের। এতক্ষণ কনট্রোল রুমে বসেছিলেন মহানায়ক।
সব কথাই পৌঁছে গিয়েছে তাঁর কানে গেছে। ঘরে ঢুকেই বললেন, ‘‘মানব, তুই উঠিস না।’’ মানবেন্দ্রর অভিমান বিলক্ষণ বুঝেছিলেন তিনি, আলাপটা তো নেহাত আর একদিনের নয়। ইউনিটের লোকজনের উদ্দেশ্যে উত্তম বললেন, ‘দেখুন, গল্পটা তো রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের নয়।তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়েরও নয়। একটু বদলে নিলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। নায়কের বন্ধুকে গায়ক করতে দোষ কী! মানবকে আপনারা ডেকেছেন, ও তো চাইবে ওর একশো ভাগ দিতে। যেমন আমার কাছ থেকেও আপনারা আশা করেন। ওর মতো এক জন গায়ক খারাপ করে কী করে গাইবে?’ তিনি ছিলেন বলেই তৈরি হল "দোলে দোদুল দোলে ঝুলনা..." যা আজও সমানভাবে জনপ্রিয়।
এহেন বন্ধুত্ব সত্ত্বেও মানবেন্দ্র উত্তম কুমারের পরিচালিত ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেননি। ১৯৭৩-এ রমাপদ চৌধুরীর গল্প নিয়ে উত্তম বানাচ্ছিলেন বনপলাশীর পদাবলী। সঙ্গীত পরিচালনার জন্যে ডাকলেন তাঁর ‘মানব’কে, প্রথমদিন গিয়েই মানবেন্দ্র দেখলেন, তিনি একা নন, শ্যামল মিত্র সহ আরো তিন-চার জন সঙ্গীতকার রয়েছেন।
শুনলেন সবাই মিলেই একই ছবিতে, একসঙ্গে সঙ্গীত পরিচালনা করবেন। ব্যাপারটা ঠিক পোষায়নি মানবেন্দ্রর। তিনি চলে এলেন, করেননি সে ছবি, বন্ধুত্ব ঘনিষ্ঠতা থেকেও তিনি অগ্রাধিকার দিলেন তাঁর আত্মমর্যাদাকে। শুধু বলেছিলেন- 'এত অ্যামেচারিশ ব্যাপার আমার পোষাবে না।’