আমার চোখে উত্তমকুমার ব্যাপারটা নাথিং স্পেশাল, আর পাঁচ জন বাঙালী নারীর মত আমার কাছেও তিনি প্রেমের মূর্ত দেবতা। তিনি সব বাঙালী নারীর না-পাওয়া চাওয়া। বালিকা থেকে কিশোরী, কিশোরী থেকে তরুণী ..তরুণী থেকে আজ, প্রায় প্রৌঢ়ত্বের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা আমি.... এই পুরো জার্নিটার প্রতিটি দিন, ঘন্টা, পল, অনুপলে জড়িয়ে আছেন উত্তমকুমার। তাঁর সেই ভুবনমোহন হাসি, অকৃত্রিম রোমান্টিক চোখের দৃষ্টি ... আমাকেও আর পাঁচটা বাঙালি মেয়ের মতোই পাগল করেছে। আর ঐ আভিজাত্য! অহঙ্কার! শুধু মাত্র তাঁকেই মানায়। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি যে কী এমন ম্যাজিক ছিল ভদ্রলোকের মধ্যে যে আজও তিনি মানুষের মনের মণিকোঠায় চিরবিস্ময় হয়ে থেকে গেলেন! প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়েও বাঙালির হৃদয়ে আজও তিনিই মহানায়ক। আর কাউকে সেই জায়গায় বসাতেই পারলাম না আমরা।
আমার দেখা উত্তমকুমারের প্রথম ছবি "খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন".. সেই সত্তর দশকের শেষের দিকে... সেইসময় বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছোট ছেলেমেয়েদের সিনেমা দেখা বারণ ছিল। অন্ততঃ আমাদের বাড়িতে ঘটনাবলী সেরকমই ছিল। তখন আমি আট কি নয়, আর দিদি এগারো হবে... বাবা নিয়ে গেলো দুই বোনকে উজ্জ্বলা সিনেমা হলে। তো সেই সিনেমা দেখে আমি আর দিদি এতো কেঁদেছিলাম যে সেই দুঃখ ভোলানোর জন্য আমার বাপি আমাদের একটা করে জেমসের প্যাকেট কিনে দিয়েছিলো। আর আমরা দুই বোন সত্যি সত্যিই ভেবেছিলাম যে ঐ লোকটা সত্যিকারের রাইচরণ যে কিনা নিজের ছেলেকে দিয়ে দিলো। উহ্ আজও ভাবলে বুকের ভিতর কেমন করে ওঠে।
তিনি যখন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান তখন আমি এগারোর। বাড়িতে টিভির প্রশ্নই নেই। কাগজ পড়ে আর রেডিও শুনে জানলাম যে উত্তমকুমার আর নেই। দিদি তখন এইট... দেখলাম ও আর ওর বন্ধুরা প্রচণ্ড উত্তেজিত। পাশের বাড়ির জেঠিমা কাঁদছে। তো বুঝলাম খুব সাংঘাতিক একটা কিছু ঘটেছে। টুকরো টুকরো কথা কানে আসছে... সুপ্রিয়া দেবী, গৌরী দেবী, সুচিত্রা সেন ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু দিদি একদিন চুপি চুপি আমাকে বললো "জানিস, আমি উত্তমকুমারের বৌ হবো ঠিক করেছিলাম".. আমি অবাক!.. ক্লাস এইটে দেখলাম "ছদ্মবেশী"... পিসির বাড়ি বেড়াতে গিয়ে... মা বাপি কেউ জানে না। ব্যস্, ঐ আমার মুগ্ধতার শুরু... সর্বনাশেরও শুরু। সেই যে উত্তম-প্রেমে পড়লাম.. আজও সেই মুগ্ধতা আর কাটলো না। আর চোরা একটা ঈর্ষারও উদয় হলো মনের ভিতর। উত্তমকুমারের সব নায়িকাদের প্রতি একটা ভয়ানক আক্রোশ জন্মে গেলো। কেন ওরা উত্তমকুমারের প্রেমিকা হবে? সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া, মাধবী, সাবিত্রী... সকলের সঙ্গে আমার শত্রুতার শুরু...
আভিজাত্যের অহংকার ছিলো বটে লোকটার। তবে সেই অহংকার কাউকে তুচ্ছ জ্ঞান করা নয়। তাঁর ভালোবাসার মধ্যে দিয়েই প্রকাশ পেতো সেই আভিজাত্য। ঝিন্দের বন্দী মনে পড়ে? শঙ্কর সিং আর গৌরীশংকর রায় দুটো চরিত্রে উত্তমকে দেখে কাকে যে বেশি ভালোবাসবো কিছুতেই ঠিক করে উঠতে পারি নি। তপন সিংহের উপর খুব রাগ হয়েছিলো। পরে ভেবেছিলাম ঠিকই ছিলো। উত্তমকুমারকে কোনো খারাপ চরিত্রে দেখলে ভালো লাগতো না একটুও। মাধ্যমিক দেওয়ার পর হারানো সুর... আমি হারিয়ে গেলাম। আমি তখন রমা হয়ে গেছি। দেয়া নেয়াতেও আমি তনুজা। সাগরিকাতেও আমি সাগরিকা।আর সপ্তপদীতে তো রিণা ব্রাউন কখনোই সুচিত্রা সেন নন। উত্তমকুমারের সব নায়িকা আমি ছাড়া কেউ হতেই পারে না। অন্য কোনো মেয়ে যদি উত্তমকুমারকে ভালোবাসার কথা বলতো মনে মনে বলতাম .."ওসব ছাড়ো। উত্তমকুমার শুধুমাত্র আমার"...
আসলে এই মানুষটিকে নিয়ে কোনো বাঙালিরই বিশেষ করে বাঙালি নারীরই কথা শেষ হবে না কখনোই। কতো কিছু পড়েছি, শুনেছি তাঁর সম্পর্কে কিন্তু সেসব আমার মুগ্ধতার জমাট প্রাচীরে একটা আঁচড়ও কাটতে পারে নি। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই "নায়ক" ছবির নায়ক অরিন্দমকে.. যে বলছে "আই উইল গো টু দ্য টপ, দ্য টপ, দ্য টপ"... যে ডায়ালগ বহুবার আমাকে চূড়ান্ত অবসাদের অন্ধকার থেকে জীবনে আলোর পথে ফিরিয়ে এনেছে...
আজ তাঁর জন্মদিনে অন্তরের সমস্ত ভালোবাসা বাংলার এক এবং অদ্বিতীয় মহানায়ককে দিলাম ...