উত্তম কুমার : যে গল্পে নিশ্চিন্দিপুর ও ভবানীপুর এক হয়ে যায়

উত্তম কুমারের জন্ম হয়েছিল মামার বাড়িতে। আহিরিটোলায়। ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। জ্ঞান হতে বুঝলেন, ভবানীপুরে তাঁর নিজের বাড়ি। সেই বাড়িতে তাঁর একটি দিদি আছে। নিজের দিদি। খুকিদি। ভালো নাম, পুতুল। কয়েক বছর আগে সে জন্মেছে। উত্তম কুমার তাঁর 'আমার আমি' স্মৃতিচারণায় দিদি বিজড়িত যে শৈশবের বর্ণনা দিয়েছেন, তা যেন স্মরণ করিয়ে দেয় 'পথের পাঁচালী'-র নিশ্চিন্দিপুরের অপু ও দুর্গার কথা। খুকিদির পরিণতিও হয়েছিল দুর্গার মতো। ক'দিনের জ্বরে মারা গিয়েছিল। তখন উত্তমের বয়স মাত্র পাঁচ-ছয়। সেকালের ছেলেবেলা তো অন্যরকম ছিল। সেকালে ছোটরা জানত ভাইবোন হওয়া মানে,--ঠাকুর এসে তাদের দিয়ে গেছেন। আর কেউ মারা যাওয়া মানে,--ঠাকুর তাকে নিজের কাছে নিয়ে গেছেন। সে গেছে স্বর্গে, নারায়ণের বাগানে ফুল তুলতে। ইচ্ছে হলেই আবার ফিরে আসবে। উত্তমও তাই জানতেন। শুরু হল অপেক্ষার পালা।  কিন্তু, অপেক্ষাই সার হল। খুকিদি আর ফিরে এলো না। কেন এলো না? কে জানে!

 

বাবা ছিলেন সিনেমার প্রোজেক্টর অপারেটর। জ্যাঠামশাইয়ের ছিল শখের যাত্রাথিয়েটারের দল, 'সুহৃদ সমাজ'। বছর পাঁচ যখন বয়স, তখন বাবা উত্তমকে দিলেন স্কুলে ভর্তি করে। পড়াশুনার ব্যাপারে বাবা ভীষণ কড়া। কিন্তু, এই বয়সে পড়তে কী আর ভালো লাগে! অদূর-ক্লাবে জ্যাঠামশাইদের মহলা চলছে। মন পড়ে আছে সেখানে। সে কী আর পড়ায় বসতে চায়! ইচ্ছে করছে ছুট্টে এক্ষুনি সেখানে চলে যেতে।  কিন্তু, খুকিদি হচ্ছে কড়া পাহারাদার। তাকে বাবাই এ-কাজে বহাল করেছেন। তার চোখ এড়িয়ে যায় সাধ্য কার! পাহারাদার হিসেবে যদিও সে বেশ চৌকস; তবু, বজ্র অটুনির ফাঁক একটা থেকেই যায়, সেটাই নিয়ম। সেই ফাঁকেই পড়ার টেবিল থেকে উত্তম মহলাঘরে উঁকি মারার সুযোগ জুটিয়ে ফেললেন। বড়দের চোখ এড়িয়ে, লুকিয়ে। সে দেখা তো দেখা নয়, যেন গেলা। কিন্তু, উত্তম সবার চোখ এড়াতে পারলেও, পারলেন না খুকিদির চোখ এড়াতে। যাওয়ার সময় একদিন ধরা পড়ে গেলেন। চেপে ধরে দিদি জিজ্ঞেস করল, 'এই, লুকিয়ে কোথায় যাস রে?' উত্তম জানালেন, 'সে এক মজার জায়গায়। বলা যাবে না।' দিদি বলল, 'ইস, বলা যাবে না! ভারি তো! আমি সব জানি। জ্যাঠামশাইয়ের মহলায় যাস, না?' উত্তম বুঝলেন, ধরা পড়ে গেছেন। এবার বাবার মার ঠেকায় কে! সেই মারের কথা ভেবেই তাঁর কান্না পেয়ে যায়। কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, 'দিদি রে, বাবাকে কিন্তু বলিস না!' দিদি হ্যাঁ-না কিছুই বলল না, শুধু বলল, 'দেখে দেখে কী শিখেছিস দেখা তো!' দিদিকে হাতে রাখতে অভিনয় করে দেখালেন উত্তম। অভিনয় বলতে, একজায়গায় দাঁড়িয়ে ডায়লগ ঝাড়া মুখস্থ বলে গেলেন, যেমন জেঠুরা বলেন; আর তাই দেখে দিদির সে কী কুটোপাটি হাসি! নাটক-পালায় কেউ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে নাকি, ঘুরে ঘুরে বলে তো! কি অপমান! উত্তমের খুব রাগ হল। কিন্তু, সে রাগ তো আর দেখানো যায় না, দিদি যদি চটে গিয়ে বাবাকে বলে দেয়!

 

পাঁচ বছর বয়সের স্মৃতি কত আর দীর্ঘ হয়! বিস্মৃতির বুক ছুঁয়ে জেগে থাকে কিছু টুকরো টুকরো ছবি। তারই একটিতে পাওয়া যায় আরেক দিনের ছবি। তখন দিদির জ্বর হয়েছে। দিদির কাছে যাওয়া মানা। তবুও, উত্তম গেলেন। লুকিয়ে। মনে সেদিনের অপমানের অভিমান। তবুও, গেলেন। দিদির অসুখ। ভাইকে কাছে পেয়ে শুকনো ঠোঁটে ফুটে উঠল এক চিলতে খুশি। বলল, 'আমি বাবাকে কিচ্ছু বলব না রে, কাউকে বলব না। তোর অভিনয় খুব ভালো হয়েছিল। আমি যখন সেরে উঠব, তখন আবার অভিনয় করে দেখাস, কেমন?' উত্তমের সব রাগ সব অভিমান যেন নিমেষে গলে জল হয়ে গেল। ভারি আহ্লাদ হল। সেই আহ্লাদে মাথা নাড়লেন উত্তম। অভিনয়টা তাহলে ভালোই হয়েছিল! বাকি রইল শুধু হাঁটাচলা শেখা। দিদি ভালো হতে হতে সেটাও শিখে নেওয়া যাবে। তারপর দিদিকে একেবারে তাক লাগিয়ে দিতো হবে! কিন্তু...কিন্তু, তার আর অবসর হল না। দিদি চলে গেল ভগবানের কাছে। পরিজনের স্তোক পেরিয়ে দিনের পর দিন কেটে গেল। দিদি ফিরল না। তাহলে, যে যায়, সে কী আর ফেরে না? পৃথিবীর বয়স হল, উত্তমেরও। বুঝলেন, যে যায় সে আর ফেরে না। শুধু থেকে যায় স্মৃতিতে, থেকে যায় সত্তায়...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...