ভবানীপুরের সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় ও চপলা দেবীর জেষ্ঠ্যপুত্রের অরুণ চ্যাটার্জী, অরুণ কুমার, উত্তম চ্যাটার্জী থেকে এক্কেবারে আপামর বাঙালীর মনের মানুষ সর্বোপরি মহানায়ক উত্তম কুমার হয়ে ওঠার যাত্রাপথ নেহাত খুব মসৃন ছিল না। আর তাই মৃত্যুর ৪০বছর পর এ প্রজন্মের কাছেও তার উপস্থিতি এতোটুকু মলিন হয়নি। আর হবেই বা কি করে! অমন আদ্যপান্ত ভদ্র, বিনয়ী, অমন হাসি, স্টাইল, সাবলীল বাচন ভঙ্গী, এক্সপ্রেশন - সত্যি কি আর দেখা যায়, না দেখা যাবে! এমন স্বকীয়তা কিন্তু এখন বিরল। আর সেই স্বকীয় ভঙ্গিতেই তিনি আজও জীবন্ত। হলফ করে বলতে পারি, এখনো তার ছবি মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়েই দেখেন। এবার বলি এই মহানায়ক হয়ে ওঠার কথা সাথে আমার ব্যক্তিগত কিছু মত।
অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল প্রথম থেকেই, সেই সূত্রে থিয়েটারের দল ‘সুহৃদ সমাজ’ গড়ে তোলেন , বেশ নামও হয় পাড়ায়। কিন্তু স্বপ্নের পথে হাঁটা তো আর সহজ নয়। শুরু হয়েছিল প্রত্যাখ্যান দিয়েই। ১৯৪৮সালে চিত্র পরিচালক নীতীন বসুর হাত ধরে ‘দৃষ্টিদান’ ছবি দিয়ে শুরু হলেও তা বক্স অফিসে ধরাশায়ী হয়। অর্থাৎ দর্শকের প্রত্যাখ্যান। এরপর, আরো বেশ কিছু ছবিতে এই ধারা অব্যাহত থাকে। পরিচিত হন ‘ফ্লপমাষ্টার' নামে। কিন্তু ছাড়েন নি হাল। বুঝেছিলেন ফিরতে হবে এক্কেবারে নতুন ভাবে। হলোও তাই- ফিরলেন এক্কেবারে নতুন ভাবে, হলেন উত্তমকুমার। ‘বসু পরিবার’ ও ‘সাড়ে চুয়াত্তর-এ তার সাফল্যের ভিত স্থাপন হলেও ১৯৫৬সালে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ মুক্তির পর বাঙালির ম্যাটিনি আইডল হতে আর সময় লাগেনি তাঁর। এরপর ‘শাপমোচন’, ‘হারানোসুর’, ‘পথে হল দেরি’, ‘ইন্দ্রাণী, মৌচাক, অগ্নিস্বর, চৌরঙ্গী- সহ একাধিক হিট। বাংলা সিনেমা খুঁজে পেলো তার নায়ককে। সেই দর্শকই তাকে আপন করে বানালেন ‘মহানায়ক’।
বেশ কিছু হিট সিনেমা ‘দেয় নেয়া, ‘হারানো সুর’ প্রযোজনাও করেছেন। এমন এক অভিনেতা যিনি যে কোনো চরিত্রেই ছিলেন সাবলীল। শুধু কি নায়ক বাঘবন্দী খেলা, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, বহ্নিশিখা, আরো বেশ কিছু সিনেমায় খলনায়কের চরিত্র তাকে অন্যন্য মাত্রায় প্রতিষ্ঠা করেছে। আর ‘স্টারডম’ সেটার সূচনাও বাংলা সিনেমায় তাঁর হাতেই।
তাঁর প্রত্যেকটি সিনেমাই এক একটা মাইল ফলক। তবে তাঁর আন্তর্জাতিক পরিধিতে পদার্পন ঘটে সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ এর হাত ধরে। তারপর বেশ কিছু অনবদ্য সৃষ্টি। ১৯৬৭সালে ‘চিড়িয়াখানা’ ও ‘এন্টনী ফিরিঙ্গী’র দৌলতে পান জাতীয় পুরস্কার।
উত্তম কুমার বেশ কিছু হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। যদিও আমার কাছে সেগুলো ততটা পছন্দের নয়। কারণ আদ্যোপান্ত বাঙালিয়ানায় ভরপুর এক মার্জিত, বিনীত চেহারা সেটা বাংলা চলচিত্রের তথা বাঙালির একমাত্র সম্পদ। তাই তিনি এ প্রজন্ম কেন আগামী প্রজন্মের কাছেও মহানায়ক হয়েই থাকবেন। আরো একটু স্পষ্ট করে বললে বাঙালি যেখানে যতদিন থাকবে তিনিও স্বমহিমায় মহানায়ক হয়েই থাকবেন।