বাংলা নাট্যমঞ্চের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন উৎপল দত্ত। তাঁর জন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ অবিভক্ত বাংলার বরিশালে। বিংশ শতকের প্রথম দশক থেকেই রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আরো বদলে যেতে থাকলো অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক মূল্যবোধ এবং বাহ্যিক আচার আচরণ। যা চল্লিশের দশকে গিয়ে পুরোপুরি পরিণত হল। তাঁর বেড়ে ওঠার সময় কাল ঠিক এই সময়েই। এই মহাপুরুষের পিতার নাম গিরিজারঞ্জন এবং মাতার নাম শৈলবালা দত্ত। দেশ ভাগের পর তাঁরা স্থায়ী ভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে থেকে যান। তাঁর পড়াশুনো শুরু হয় শিলং এর এডমন্ডস স্কুলে। তারপর কলকাতার সেন্ট লরেন্স ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। ১৯৮৭ সালে ইংরেজি অনার্সে স্নাতক হন তিনি।
স্কুল জীবনেই বাবা মার হাত ধরে তাঁর প্রথম পেশাদারি থিয়েটার দেখা। আর সেই দেখেই তাঁর প্রথম প্রেম থিয়েটারের প্রতি। তিনি এই সব মহৎ কারবার দেখে তিনি মনে করেছিলেন তাঁর পক্ষে অভিনেতা ছাড়া আর কিছু হবার নেই। তাঁর বয়স তখন মাত্র তেরো। তিনি প্রথম জীবনে বাংলা নাট্য মঞ্চে বহু অভিনয় করেন। তিনি শেক্সপিয়ার আন্তজার্তিক থিয়েটার কোম্পানির সাথে বেশ কয়েকবার ভ্রমন করেন। বেশ কিছু বিখ্যাত সিনেমাতে ও অভিনয় করেন। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তিনি নাট্যকার হিসাবে বেশি খ্যাতি লাভ করেছিলেন। কলেজ জীবনেই তিনি প্রথম অভিনয় করেন। ১৯৪৭ সালে কলেজে নিকোলাই গোগলের 'ডায়মন্ড কাটস ডায়মন্ড' এবং 'মালিয়েরের দ্যা রোগারিজ অব স্ক্যাপা' তে তিনি অভিনয় করেন। নাট্যচর্চা করতে করতে উৎপল দত্ত ও তাঁর কলেজের সহপাঠীরা মিলে গড়ে তোলেন একটি নাট্যদল। আর নাট্যদলের নামকরণ করেন তারা দ্য অ্যামেচার শেকসপিয়ারিয়ান্স। তাঁদের এই নাট্যদলের প্রথম প্রযোজনা 'রোমিও এন্ড জুলিয়েট' এবং 'ম্যাকবেথ' নাটকের নির্বাচিত কিছু অংশ।
১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত পরিচালক ও অভিনেতা 'ডেফ্রি কেন্ডাল' তার নাট্যদল শেকসপিয়ারিয়ান নিয়ে ভারতে আসেন। 'কেন্ডারের' আহ্বানে উৎপল দত্ত এই দলে যোগদান করেন। শেকসপিয়ারিয়ান নাট্যদলের বেশ অনেক গুলি প্রযোজনা কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে মঞ্চস্থ করা হয়। এই নাট্যদলে তখন নিয়মিত অভিনয় করছেন উৎপল দত্ত। ইউরোপীয় থিয়েটার দলের নিয়ম কানুন শৃঙখলা উৎপল দত্তের থিয়েটার জীবনে গভীর ভাবে প্রভাব ফেলেছিল। তিনি শুধু অভিনেতা ছিলেন না তিনি ছিলেন একাধারে নাট্যকার ও নাট্য নির্দেশক। পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের দশকে তিনি ছিলেন পশ্চিম বাংলার গ্রূপ থিয়েটার আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিত্ব।১৯৪৭ সালে তিনি লিটল থিয়েটার গ্রূপ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালে পিপলস থিয়েটারে 'টিনের তরোয়াল' নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক হল 'মানুষের অধিকার', 'মেঘ', 'রাইফেল', 'সীমান্ত ঘুম নেই' , 'মে দিবস', 'দ্বীপ রাতের ,অথিতি', 'মধুচক্র', 'কল্লোল'। উৎপল দত্তের রাজনৈতিক নাটক গুলিকে তিনটি শ্রেণী বিভাগে বিভক্ত করা হয় যেমন শ্রেণী চেতনা ,ইতিহাস চেতনা ,মধ্যবিত্ত চেতনা। তাঁর শ্রেণী চেতনা মূলক নাটক গুলি হল টিনের তরোয়াল ,রাতের অথিতি ,ছায়ানট ,সূর্যশিকার ,মানুষের অধিকার। তাঁর ইতিহাস চেতনা মূলক নাটক গুলি হল টোটা ,লাল দূর্গা ,তিতুমীর ,দিল্লি চলো। তাঁর মধ্যবিত্ত চেতনা মূলক নাটক গুলি হল অঙ্গার ও ফেরারী ফৌজ। ১৯৯৩ সালের ১৯ শে আগস্ট ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬৪ বছরে মৃত্যুবরণ করেন।