উৎপল দত্ত, মঞ্চ আর রুপোলি পর্দা দুই জায়গাতেই অবাধ বিচরণ ছিল তাঁর। বেতার থেকে টেলিভিশন স্ক্রিন, নাটক রচনা থেকে ছবিতে অভিনয়, নির্দেশনা সর্বত্রই উৎপল স্বমহিমায় উজ্জ্বল। হাস্যকৌতুক অভিনেতা থেকে দুঁদে ভিলেন সব চরিত্রেই, তিনি ফিট অ্যান্ড ফাইন। যদিও নিজেকে মঞ্চে দেখতেই তিনি পচ্ছন্দ করতেন। বাংলা হিন্দি চলচ্চিত্র কাঁপানো এই অভিনেতার সঙ্গে সত্যজিতের আত্মিক সম্পর্ক ছিল। অভিনয়ের বাইরেও তাঁরা দুজনে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
ছয়ের দশক রাজনীতির উত্তাপে উত্তপ্ত ছিল কলকাতাসহ গোটা বাংলা। সত্যজিৎ সে সময়ে লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে থাকতেন। একদিন বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, ঘড়িতে রাত প্রায় পৌনে একটা বাজে। হঠাৎ বেজে উঠল মানিক বাবুর বাড়ির ফোন। রিসিভ করলেন। কী কথা হল, শোনা যায়নি, তবে এপার থেকে মানিক বাবু বললেন, “আমি আসছি।” ফোন রেখেই পাঞ্জাবি-টাঞ্জাবি পরে তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন প্রায় এক-দেড় ঘণ্টা বাদে। বিজয়া রায় জিজ্ঞেস করতেই বললেন, “উৎপলকে পুলিশ ধরেছিল। ছাড়িয়ে আনলাম।”
হ্যাঁ, এটাই ছিল দত্ত ও রায়ের সম্পর্কের সমীকরণ। তখনও তাঁরা পরিচালক আর অভিনেতা সম্পর্কে বাধা পড়েননি। পেশাদারিত্ব নয়, একেবারে ব্যক্তিগত ছিল তাঁদের সম্পর্ক। উৎপল দত্তের নাটক দেখতে ভীষণ পছন্দ করতেন সত্যজিৎ। নিয়মিতই তাঁর নাটক দেখতে যেতেন সত্যজিৎ।
তবে মানিক বাবু কেবল উৎপল দত্তের নাটকেরই যে ফ্যান তা কিন্তু নয়। ওঁর পরিচালিত ছবির প্রতিও মানিক বাবুর অগাধ অনুরাগ ছিল। উৎপল দত্তের পরিচালিত ‘মেঘ’ ছবিতে রবি ঘোষকে দেখেই 'অভিযান’-এর জন্য তাঁকে মনোনীত করেন সত্যজিৎ।
সত্যজিৎ-এর বাড়িতে নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল উৎপল দত্তের। কিন্তু তখনও নিজের ছবিতে ওঁকে কাস্ট করেননি বাঙালির সাত রাজার ধন এক মানিক, বরেণ্য এই পরিচালক। একদা ঠিক হয়, শঙ্করের লেখা গল্প নিয়ে সত্যজিৎ-এর বানানো ‘জন অরণ্য’ ছবিতে ‘বিশুদা’ হবেন উৎপল দত্ত। সেই শুরু হল উৎপল-সত্যজিৎ যাত্রা।
‘জনঅরণ্য’ ছবিতে উৎপল দত্ত সময়ের হিসেবে ছোট্ট একটি ভূমিকায় কাজ করলেও, তা ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ঐ বিশুদাই বঙ্গসন্তানদের ব্যবসার মন্ত্র শিখিয়ে গেলেন। বড়বাজারে ওই দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল। ভিড়-ভাট্টা, হইচই, হট্টগোল, চেঁচামেচি, এক্কেবারে ঘিঞ্জি জায়গা।
শুটিং শেষে ফেরার পথে, প্রদীপ বাবু (প্রদীপ মুখোপাধ্যায়, ছবির নায়ক) বলছেন, “আর বায়োস্কোপ নয়।” ও রকম অবস্থায় মাথা ঠান্ডা রেখে অভিনয় করা সহজ ছিল না। মানিক বাবুর চেয়ে উৎপল দত্তের জন্যে বেশি লোক জমত, তাঁকে দেখার জন্য বেশি ভিড় হত সে সময়ে। কারণ, ঐ সময়ে একের পর এক হিন্দি ছবিতে অভিনয় করছেন উৎপল দত্ত। কিন্তু এইসব স্টারডাম তাঁকে ছোঁয়া তো দূরের কথা, বিন্দুমাত্র বিচলিত করত না। কারণ তাঁর কাছে অভিনয় বিপ্লব আর প্রতিবাদের ভাষা। মঞ্চে তিনি নট প্রোপাগাণ্ডিস্ট। আর চলচ্চিত্রে তিনি পেশাদার অভিনেতা। কেরানি যেমন কলম পেষেণ, তিনি তেমন জীবনধারণের জন্যেই সিনেমায় অভিনয় করতেন, এটাই অভিনেতা উৎপলের সম্পর্কে মানুষ উৎপলের নিজের উক্তি।
জনঅরণ্যের পরে পরবর্তী দু-আড়াই দশকে মানিক বাবুর আরও তিনটে ছবিতে অভিনয় করেন উৎপল দত্ত। ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ এবং ‘আগন্তুক’, প্রত্যেকটি ছবির প্রধান চরিত্র যেন উৎপলের জন্যই তৈরি করেছিলেন তাঁর মানিক দা। উৎপল দত্তই ছিলেন তিনটি ছবিরই প্রোটাগনিস্ট। পরিচালকের ফার্স্ট চয়েজও ছিলেন তিনিই। চরিত্র তিনটিই একে অন্যের থেকে একেবারে আলাদা। তিনটিই তিনটি স্বাদের, হীরক রাজার দেশে আর জয় বাবা ফেলুনাথে কিছুটা মজার ভিলেন হলেও আগন্তুকে একেবারে সিরিয়াস।
‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবির মধ্যমণি ছিলেন মগনলাল মেঘরাজ। ফেলুদার সবচেয়ে দুঁদে ভিলেন মগনলাল, ফেলুস্রষ্টা সত্যজিতের অত্যন্ত প্রিয় ভিলেন মগনলাল। ফেলু গপ্পে ভিলেনদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বার মগনলালের সঙ্গেই সাক্ষাৎ হয়েছে ফেলুদা অ্যান্ড কো-এর। সেই চরিত্রে উৎপল দত্তের মতো অসাধারণ অভিনেতা! মনে পড়ে সেই দৃশ্য অর্জুন কো বুলাও, তারপর নাইফ থ্রোয়িং-এর দৃশ্য। এরকম সাংঘাতিক আবার মজাদার ভিলেনের চরিত্রে হয়তো একমাত্র তিনিই অভিনয় করতে পারতেন। এই ছবিরই ক্ল্যাইম্যাক্সে এক্কেবারে পেনাল্টিমেট দৃশ্যে দশাশ্বমেধ ঘাটের মগনলালকে গুলির সিনের শুটিং হয়েছিল ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে। দেওয়ালে যে গুলি লাগে, সেটা আসলে ফাঁপা ছিল, এক্সপ্লোসিভ দেওয়া। নেগেটিভ-পজিটিভ ম্যাচ করতেই বার্স্ট করবে এমন। সেই সিনেই একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন উৎপল দত্ত। কিন্তু তিনি তো উৎপল দত্ত, তাই ভয় এবং অভিনয় দুটোকেই যেন এক করে দিয়েছিলেন। যা দেখে সকলেই চমকে গিয়েছিলেন।
পরিচালক অভিনেতা যুগলবন্দীর এক অসামান্য ছবি ছিল 'হীরক রাজার দেশে’। এই ছবির সময় আক্ষেপের সুরে মানিক বাবু তাঁর উৎপলকে বলেছিলেন, “আমি সব সময় চেয়ে এসেছি যে তুমি আমার ছবিতে নিজে ইম্প্রোভাইজ করো। কিন্তু এ ছবির সংলাপ এমনই যে, সে রকম সুযোগ নেই।”
হীরক রাজা চরিত্রে এক অসামান্য অভিনয়শৈলী প্রদর্শন করেন উৎপল দত্ত। অনবদ্য অভিনয় আর চোস্ত সংলাপের ছন্দে মুগ্ধ হয়েছিল তামাম দুনিয়ার দর্শক। এ ছবি, ছোটদের ছবিতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলে। মগজ ধোলাইয়ের বিরুদ্ধে শিক্ষকের লড়াই আর শেষে জিতে যাওয়া দড়ি ধরে মারো টান রাজা হবে খান... খান...!
এই পরিচালক-অভিনেতা জুটি, শেষেবারের মতো দেখা গিয়েছিল আগন্তুক ছবিতে। আজ এ ছবি আরো প্রসঙ্গিক, সভ্যতার সংকট। তালিবানী আগ্রাসনে মানবাধিকার বিধ্বস্ত, সেখানে বেশি করে মনে পড়ছে মনমোহন মিত্রের কথা গুলো। এ ছবিতে সত্যজিৎ সভ্যতা, নগরসভ্যতা, ধর্ম, ধর্মীয় আগ্রাসন, মৌলবাদ সবকিছুকেই সরাসরি আঘাত করেছেন। এই আঘাত তিনি উৎপল দত্তের মুখ দিয়েই করিয়েছেন। আগন্তুক-এর সময় উৎপল দত্তের শরীর খুব একটা ভাল ছিল না। কিন্তু ক্যামেরা চললে তা বোঝার উপায় থাকত না। একেবারে সাবলীল। সত্যজিৎ উৎপল দত্তকে ডেকে বলেছিলেন, “এই ছবিতে তুমি আমার মুখপাত্র। আমার যা বলার তোমার মুখ দিয়ে বলাচ্ছি।”
শুটিং শেষ হয়ে যেতে উৎপল দত্ত সত্যজিতের হাত চেপে বলেছিলেন, “আপনি যা চেয়েছিলেন, তা আমি করতে পেরেছি বলে মনে হয় না।” মানিক বাবু পাল্টা বলেন, “তুমি সেটা না দিতে পারলে ছবি শেষ হত না।”
তিনি এও বলেছিলেন, 'উৎপল যদি রাজি না হত, তবে হয়তো আমি ‘আগন্তুক’ বানাতামই না।’ ‘আগন্তুক’ ছবিতে উৎপল দত্তকে নিজের প্রতিভূ হিসেবেই ব্যবহার করেছিলেন সত্যজিৎ। সভ্যতা যত এগোবে এ ছবির প্রাসঙ্গিকতা তত বাড়তে থাকবে।
এ তো গেল কাজের সূত্রে আলাপের গপ্পো। যা আত্মীয়তায় পরিণত হয়েছিল পরবর্তীতে। এছাড়াও আরো এক মিল রয়েছে দুজনের। উত্তর কলকাতার এস এন ব্যানার্জি রোডে কলকাতা পৌরসভার সদর দপ্তর লাগোয়া ৪৫ মতিশীল স্ট্রিটের এক কাপড়ের দোকান মিলিয়েছে তাঁদের। এই দোকানের পোশাক বানানোর কারিগর ছিলেন রশিদ। এই দোকান থেকেই রশিদের বানানো পোশাকের অর্ডার দিতেন সত্যজিৎ রায় এবং উৎপল দত্ত। তাঁদের ছবি ও নাটকের বিভিন্ন চরিত্রের পোশাকের এখান থেকেই যেত।
মানিকের ছবিকে প্রথম থেকেই বারবার কুর্নিশ করেছেন উৎপল দত্ত। ‘পথের পাঁচালি’ দেখে সত্যজিৎকে তিনি এক আবেগরুদ্ধ চিঠি লিখেছিলেন। সত্যজিৎকে তিনি ‘স্যার’ বলেই ডাকতেন। সত্যজিৎও মুগ্ধ ছিলেন উৎপলের অভিনয় ও মেধায়।