তাঁর কথায় - "ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত এতটাই অপূর্ব এবং বিস্ময়কর যে, এর জ্ঞান এবং শুদ্ধতা অর্জনে একজন তাঁর সারা জীবন অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারে এবং তারপরও অনুভব করতে পারে সে কেবল সমুদ্রের একটা ফোঁটা কেবল স্পর্শ করতে পেরেছে। এই খোঁজা এবং আবিষ্কারের পাশাপাশি শেখাটাও কখনো বন্ধ হয় না।"
তাঁর সরোদের সুরের মূর্ছনায় ভেসে যায় আপামর বিশ্ববাসী। চারিদিকে যখন এক অতিমারীর ভয়ের আবহ, তখন ফের তাঁর সরোদ মৃত্যুঞ্জয়ী আশার সঞ্চার করে। "কনসার্ট ফর হোপ" -এ তাঁর সরোদ বেজে উঠতেই মোহিত হন বিশ্ববাসী। তিনি ওস্তাদ আমজাদ আলি খান, বিশ্বের অন্যতম সেরা সরোদবাদক।
প্রচলিত আছে যে তাঁর এক পূর্বপুরুষই সরোদ আবিষ্কার করেন। গোয়ালিয়রের রাজসভার সভাগায়ক উস্তাদ হাফিজ আলী খান এবং রাহাত জাহানের ছয় সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ সন্তান আমজাদ আলী খান। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয়েছিল মাসুম আলী খান। কিন্তু এক সন্ত তাঁর নাম পরিবর্তন করে রাখেন আমজাদ। বঙ্গাশ ঘরানার এই শিল্পীর খুব ছোট বয়স থেকে বাবার কাছে সরোদ শিক্ষার শুরু হয়।
তাঁর কথায়..."আমার বাবার কাছে সংগীতের বাইরে জীবনের অন্য কোনো মানে ছিল না। তাঁর কাছে জীবন নিজেই এক সংগীত এবং সংগীত হচ্ছে জীবন। এবং আমিও, প্রকৃতিগতভাবে এসেছি পাঁচ পুরুষের এই সাংগীতিক ঐতিহ্যকে বহন করে নিয়ে যেতে..."
মাত্র ছ বছর বয়সে তিনি এককভাবে বাজিয়ে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। দশ এগারো বছর বয়স থেকেই তিনি বিভিন্ন সঙ্গীতানুষ্ঠানে সরোদ বাজাতে শুরু করেন। তারপর থেকে একটানা সত্তর বছর ধরে বাজিয়ে চলেছেন। ১৯৬৩ সালে প্রথমবার আমেরিকায় পারফর্ম করেন। সরোদ নামক অসাধারণ এই যন্ত্রটিকে টিকিয়ে রাখা এবং জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে যাঁদের অসামান্য অবদান রয়েছে তাদের মধ্যে ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের নাম অন্যতম। 'সরোদ' শব্দটির অর্থ সুন্দর সুর বা মেলোডি। আমজাদ আলী খান এই সুরকেই ছড়িয়ে দিয়েছেন সারা বিশ্বে। ২০১৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার কনসার্টে অংশগ্রহণ করার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ... ভারতের এই তিনটি সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মানেই তাকে ভূষিত করা হয়েছে। ইউনেস্কো পুরস্কার সহ বিশ্বের বহু পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের ক্রিস্টাল অ্যাওয়ার্ড ও পেয়েছেন তিনি। ইউনিসেফের জাতীয় প্রচারদূতও হন তিনি। বিদেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন ইউকের ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি এবং সিয়াটলের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি, নিউইয়র্কের স্টোনি ব্রুক ইউনিভার্সিটিতে তিনি সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেছেন।
তাঁর দুই পুত্র আয়ান আলী এবং আমান আলী দুজনেই তাঁর সার্থক উত্তরসূরি।
তাঁর বাবা উস্তাদ হাফিজ আলীর সঙ্গে সখ্য ছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তাঁদের স্মরণে এবং সম্মানে আরেক বিশ্ববিখ্যাত রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী সুচিত্রা মিত্রর সঙ্গে তিনি একটি অ্যালবাম তৈরি করেন যে অ্যালবামে রয়েছে সুচিত্রা মিত্রের গানের সঙ্গে ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের সরোদ। নিজে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য রাগ। দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধি দেওয়া হয়েছে।
প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা বই "মাস্টার অন মাস্টার্স"...
খুব কম কিন্তু অত্যন্ত ট্যালেন্টেড এবং ডিভোটেড কয়েকজন ছাত্রকে তিনি সরোদের তালিম দেন যাদের কাছ থেকে কোনো পারিশ্রমিক নেন না।
কলকাতা তাঁর অতি প্রিয় শহর। বহু সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন কলকাতায় অনুষ্ঠান করে তিনি সবথেকে বেশি আনন্দ পান।
এত পুরস্কার এত সম্মানপ্রাপ্তির পরও বিনয়ী এই শিল্পী বলেন..."সঙ্গীতের যে উত্তরাধিকার আমার পিতাজীর কাছ থেকে পেয়েছি তাইই আমার পরম সম্পদ। আমি প্রকৃত অর্থে শিল্পী হতে চাই... ভালো, আরো ভাল, আরো আরো ভাল হতে চাই"...
প্রকৃত গুণী মানুষেরা এমনই হন– তাই না?
তথ্য ঋণ: বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের সাক্ষাৎকার