শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তাপস-ঋষি ওস্তাদ আমির খাঁ-সাহেব

ওস্তাদ আমির খাঁ-সাহেব ছিলেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঋষি-তপস্বী। তাঁকে মজলিশ-মেহ্ফিলে সশরীরে দেখার সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছে, তাঁরা জানেন, আসরে তিনি ঋষির মতোই সৌম্য মূর্তিতে ধীরে এসে বসতেন। 



বসতেন, তপস্যার মুদ্রায়। তারপর চোখ বন্ধ করে মগ্ন হতেন স্বর-সাধনায়। আলাপ-তান-তারানার কারুকাজে মুহূর্তের জন্য তাঁর সেই শান্ত-সৌম্য-সমাহিত মুখমন্ডলে সামান্যতম বিকৃতিরও উদ্ভাস হত না। মেহ্ফিল শেষ না-হওয়া অব্দি তাঁর এই ভাব-ভঙ্গিমার কোন পরিবর্তনও দেখা যেত না।



আর একটি বিশিষ্টতা তাঁর সঙ্গীত পরিবেশনায় দেখা যেত, তা হল, তিনি কখনোই কালোয়াত ছেড়ে বাক-বিলাসী ঠুমরি দিয়ে আসর জমাতে চাননি। তাই বলে, ঠুমরিকে তিনি 'দূর ছাই' করতেন, এমনটাও নয়। গাইতেন, তবে তা নিতান্তই কাছের মানুষের অনুরোধে, একান্ত ঘরোয়া আড্ডায়।



আরও একটি বিশিষ্টতা ছিল তাঁর সঙ্গীত পরিবেশনায়, তা হল, যন্ত্রানুষঙ্গের বাহুল্যহীনতা। খান-দুই তানপুরা, একটি মৃদুভাষী হারমোনিয়াম, আর একখানা গতে বাঁধা বাঁয়া-তবলা। ব্যস। আসল জাদু তাঁর সিদ্ধিলব্ধ কণ্ঠে, নিজস্ব গায়কীতে, চিত্রমুখর স্বরবিস্তারে, অনভিপ্রেত কারুকাজে। সেই জাদুতেই তিনি আসরশুদ্ধ শ্রোতাদের নিমেষে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলতেন। আত্মা-পরমাত্মা সঙ্গীতময় না-হলে এমনটা সম্ভব হত না।

UstadAmirKhan1

সঙ্গীতের এই অধিকার আমির খাঁ-সাহেব অবশ্য উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলেন। শোনা যায়, তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন খোদ মুঘল দরবারের সভাগায়ক। আর তাঁর আব্বাজান ওস্তাদ শাহমীর খাঁ-সাহেব ছিলেন বিশ শতকের প্রথম অর্ধের বিখ্যাত সারেঙ্গীবাদক।



১৯১২-তে জন্ম নেওয়া আমির খাঁ-সাহেবের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে হাতেখড়ি আব্বার কাছে। সারেঙ্গী শেখার মধ্য দিয়ে। বালক-বয়সে।



তবে, এই বয়সেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দিগন্ত আমির খাঁ সাহেবের কাছে খুলে গিয়েছিল। কেননা, শাহমীর খাঁ-সাহেবের সঙ্গে সেকালের বিভিন্ন ঘরানার বিখ্যাত বিখ্যাত সব কণ্ঠশিল্পী ও যন্ত্রশিল্পীদের দারুণ সখ্যতা ছিল। ওস্তাদ আলবান্দে খাঁ-সাহেব, ওস্তাদ জাফরুদ্দীন খাঁ-সাহেব, ওস্তাদ নাসিরুদ্দীন খাঁ-সাহেব, ওস্তাদ বীনকার ওয়াহিদ খাঁ-সাহেব, ওস্তাদ রজব আলী খাঁ-সাহেব, ওস্তাদ হাফিজ খাঁ-সাহেব, ওস্তাদ নওয়াজ বুন্দু খাঁ-সাহেব, বীনকার মুরাদ খাঁ-সাহেবের মতো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দিকপালেরা তাঁর গরীবখানায় এসে নিয়মিত মিলিত হতেন, ভাবের আদানপ্রদান করতেন, ঘরোয়া সঙ্গীতের আসর বসাতেন।



সুতরাং, বাল্যবয়সেই বিভিন্ন ঘরানার গায়কীর সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়ে এই আসর থেকে দারুণ সমৃদ্ধ হয়েছিলেন আমির খাঁ-সাহেব। তিনি যন্ত্রশিল্প থেকে কণ্ঠশিল্পের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। 



অবশ্য, আব্বাজান তাঁকে এ-ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহিত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, অত্যন্ত যত্ন নিয়ে শেখাতেও শুরু করেছিলেন। কঠিন মেরুখন্দ সরগম অভ্যাসের মধ্য দিয়ে পুত্রের কণ্ঠ সমস্ত রকম সাঙ্গীতিক কারুকাজের জন্য আদর্শ করে তুলেছিলেন।



আব্বাজানের ইন্তেকালের পর মজলিশ-মেহ্ফিলের মধ্যমণি হয়ে উঠতে গিয়ে আমির খাঁ-সাহেব নিজস্ব এক গায়নরীতির প্রয়োজন অনুভব করলেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কনসার্ট সাধারণত তিনটি লয়ে বাঁধা। 'বিলম্বিত' বা 'অতিবিলম্বিত' লয়ে শুরু হয়ে 'মধ্যলয়' পেরিয়ে 'দ্রুতলয়'-এ এসে শেষ হয়। নিজের বেলায় আমির খাঁ-সাহেব ক্রমটা প্রথমেই উল্টে দিলেন।



তারপর ঠিক করলেন যে, মেরুখন্দকে ভিত্তি হিসেবে রেখে তিনটি লয়ের জন্য তিনজন বিখ্যাত শিল্পীর গায়কীর মেলবন্ধন ঘটাবেন, যাঁদের তিনি আবাল্য শুনে বড় হয়েছেন। 



ফলে, তিনি দ্রুত লয়ের জন্য প্রসিদ্ধ জয়পুর ঘরানার রজব আলী খাঁ-সাহেবের গায়নরীতি গ্রহণ করলেন। ভিনডিবাজার ঘরানার ওস্তাদ আমান আলী খাঁ-সাহেব কখনই অতিবিলম্বিত বা দ্রুতলয়ের সঙ্গীত পরিবেশন করতেন না। তিনি ছিলেন মধ্যলয়ের জন্য সুবিখ্যাত। আমির খাঁ-সাহেব তাঁর কাছ থেকে মধ্যলয়ের গায়নরীতি গ্রহণ করলেন। বিলম্বিত বা অতিবিলম্বিত গায়নরীতি গ্রহণ করলেন কিরানা ঘরানার ওস্তাদ আব্দুল ওয়াহিদ খাঁ-সাহেবের গায়নরীতি থেকে। 



এভাবে তিনটি ঘরানা, তিনজন ওস্তাদের গায়নরীতি, মেরুখন্দ রীতি এবং নিজস্ব কারুকাজ মিলিয়ে ওস্তাদ আমির খাঁ-সাহেব যে স্বকীয় গায়নরীতি গড়ে তুললেন, তা শুধু তাঁর আপন গায়নরীতি হয়েই থাকল না; সৃষ্টি করল এক নতুন সঙ্গীত ঘরানার, তাঁর জন্মস্থানের নামে সেই ঘরানার নাম দেওয়া হল, 'ইন্দোর ঘরানা'

UstadAmirKhan2

আমির খাঁ-সাহেব বিশ্বাস করতেন, 'গুণী সঙ্গীতশিল্পী হতে গেলে হৃদয়ে কবিকল্পনা না-থাকলে চলে না।' আর এই কবিকল্পনার ব্যাপ্তির জন্যই রেকর্ডে ধৃত তাঁর খেয়াল গান শ্রোতাদের এক অনির্বচনীয়লোকের সন্ধান দেয়, আজও।



আমির খাঁ-সাহেব নিজে ছিলেন অসাধারণ এক সুরস্রষ্টা। তাঁর সেই সৃষ্টির মধ্যে সুফি ভাবনা যেমন প্রতিফলিত হয়েছে, তেমনি সর্বধর্মের মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে বিশ্বমানবতার কথা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে:

"লাজ রাখো লিযো মোরি, সাহেব, সাত্তার, নিরঙ্কার, জয় কে দাতা,

তু রহিম রাম তেরি মায়া অপরম্পার,

মোহে তোরে করম পে আধার জগ কে দাতা--"



আসলে, খাঁ-সাহেব নিজের প্রচেষ্টায় হিন্দি, উর্দু, ফারসি ও সামান্য সংস্কৃত শিখে নিয়েছিলেন; পাঠ নিয়েছিলেন গুরু নানক, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণদেব এবং সুফি সাধকদের জীবন ও বাণীর। যা তাঁকে অনুভবের স্তর বেয়ে সঙ্গীতের শুদ্ধ ও মরমীয়া সাধক হয়ে উঠতে অত্যন্ত অনুপ্রাণিত করেছিল।



সঙ্গীতজীবনের শুরু থেকেই বাংলার সঙ্গে আমির খাঁ-সাহেবের এক অদ্ভুত যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল। এখানে তাঁর অসংখ্য সখা-শুভানুধ্যয়ী-অনুরাগী তো ছিলেনই, এ-শহরে তাঁর নিয়মিত যাতায়াতও ছিল। কলকাতার কোন কনসার্ট তিনি ছাড়া সম্পূর্ণ হত না। 



সবচেয়ে বড় কথা, বাংলা ছায়াছবিতে প্লেব্যাকের মধ্য দিয়েই ছায়াছবির জগতে তাঁর প্রথম প্রবেশ। ছবির নাম, 'ক্ষুধিত পাষাণ'। ছবির পরিচালক তপন সিংহ, সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন আরেক ওস্তাদ। ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ-সাহেব। 



ছবিতে দুটি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ছিল আমির খাঁ-সাহেবের কণ্ঠে। একটি সোলো, 'ক্যায়সে কাটে রজনী', বাগেশ্রীতে বাঁধা বন্দিশ; অন্যটি প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ডুয়েট, 'পিয়াকে আওনকি', খাম্বাজ রাগে বাঁধা ঠুমরি



সবচেয়ে দুঃখের কথা, খাঁ-সাহেবের অন্তিম সময়টির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে কলকাতা। ১৯৭৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় এক মর্মান্তিক মোটর দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়...



তবে এও সত্য যে, মায়েস্ত্রোদের কখনও মৃত্যু হয় না। যেমন হয়নি ওস্তাদ আমির খাঁ-সাহেবের। মৃত্যুর প্রায় অর্ধ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও নিজস্ব গায়নরীতিতে, নিজের তৈরি ঘরানায়, রেকর্ডে, ওয়েবে, অসংখ্য অনুগামী-শিক্ষার্থীদের প্রবহমান ধারায় আজও প্রবলভাবে বেঁচে আছেন তিনি...



তথ্যঋণ: সুশীলা মিশ্র ও জি এন ঘোষ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...