পরনে জমকালো কাঞ্জিভরম। পিঠের ওপর লম্বা বেণী। কানের দু’পাশে সাদা ফুলের গজরা। কপালে কয়েন সাইজ মেরুণ টিপ। প্রথম দেখায় টিপিক্যাল দক্ষিণ ভারতীয় মহিলা ছাড়া আর কিচ্ছুটি মনে হওয়ার যো নেই। কিন্তু সব ধারণা খানখনা হয়ে যায় যখন তিনি হাতে নেন মাইক্রোফোনটি। ওই গলা গোটা গান বিশ্ব যে এক নামে চেনে! ঊষা উত্থুপ। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য এক হয়ে যায় তাঁর কাছে।
এদেশে পপ সম্রাজ্ঞী তিনি। উপমহাদেশের গানপ্রেমী মানুষের কাছে পাশ্চাত্য পপ সঙ্গীত ঘরের গান হয়ে উঠেছিল কিছুটা তাঁর দৌলতেই। অথচ এই গলার জন্যই তাঁকে একদিন বের করে দেওয়া হয় মিউজিক ক্লাস থেকে। তখন ঊষা সেন্ট অ্যাগনেস স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। অন্য পড়ুয়াদের থেকে এই মেয়ের গানের গলা একেবারে আলাদা! কে তাকে গান শেখাবে। তাই গানের টিচারের সেই মেয়েটিকে না-পসন্দ। তাই সে বাতিল হয়ে গেল ক্লাস থেকে। কিন্তু গানই যার জীবন হয়ে উঠবে তাকে কি আটকানো যায়! গানই প্যাশন, তাই গানের ক্লাসে বাদ পড়লেও গান থামেনি কখনও।
সেই মেয়েই ২০১৯ সালে পূর্ণ করে ফেলেছেন গান জীবনের ৫০ বছর। গান গেয়ে ফেলেছেন ১৫ টি ভারতীয় ভাষায়। সঙ্গে জার্মান, ইতালী, ফ্রেঞ্চ ভাষাও আছে। তৈরী করেছেন নিজস্ব জঁর।
তামিল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম। তাঁরা তিন বোন, দুই ভাই। সকলেই গান পাগল মানুষ। ঊষা কোনও দিন গানের ইস্কুলের ধরাবাঁধা ছকে গান শেখেননি। কিন্তু তাঁদের বাড়ি যে গানের বাড়ি। বাবা-মা দুজনেই ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল থেকে ভারতীয় সঙ্গীত শুনতেন নিয়মিত। বড়ে গুলাম আলি থেকে কিশোরী আমনকর কে নেই তাঁদের বাড়িতে। বাবা-মা-দাদা-দিদি সবাই গান শুনছে, তাঁদের সঙ্গে সঙ্গী ছোট্ট ঊষাও।
উশাদের প্রতিবেশি পুলিশের ডেপুটি কমিশনার এস.এম.এ পাঠান। ডেপুটি সাহেবের মেয়ে জামিলাও বেজায় গানভক্ত। সে শুনত হিন্দি রাগ সঙ্গীত। বন্ধু ঊষাকেও শোনাতে ছাড়ত না। সেভাবেই ই তামিল পরিবারের মেয়ে ঊষার হিন্দি শেখা।
বছর নয়েক যখন বয়সে করে ফেলেন নিজের জীবনের প্রথম পাবলিক পারফর্ম্যান্স। রেডিয়ো সিলনও চলত ওভেলটিন মিউজিক আওয়ার, সেখানে একবার গান গাওয়ার সুযোগ পেলেন ঊষা, শিল্পী আমিন সায়ানির সৌজন্যে। ঊষা গেয়েছিলেন ‘মকিং বার্ড হিল’। ঊষার দিদিরা গান গাইতেন, তাঁরাই বোনকে নিয়ে যান।
বছর কুড়ি বয়সে নাইট ক্লাবে গান গাওয়ার শুরু। পাশ্চাত্য গান মানেই খোলামেলা পোশাকে গান গাওয়া- এক ধাক্কায় ভেঙ্গে দিয়েছিলেন সেই মিথ। শাড়ি আর গজরায় সেজেও যে বিদেশি গানের সুরে ঝড় তোলা যায় দর্শকদের মধ্যে দেখিয়ে দিয়েছিলেন ঊষা! আসল ব্যাপার হল পারফর্ম্যান্স! আর কিচ্ছু লাগে না।
জীবনে একবার নয় বারবার প্রত্যাখ্যানের মুখে পড়েছেন। গানের ওপর নেমে এসেছে বিপদের খাঁড়া। ঊষা কিন্তু অনড়। একেবারে শক্ত শিকড়ের গাছের মতো। তাঁকে টলানো যায়নি যায়নি গানের পথ থেকে। মুখে হাসি নিয়ে সামলেছেন সব ঝড়।
ঊষার জন্ম স্বাধীনতার বছরে। ১৯৪৭-এর ৭ নভেম্বর বোম্বাই শহরে। বাবা বৈদ্যনাথ সোমেশ্বর স্বামী আইয়ার। সেই দিক থেকে ঊষার জীবনের প্রথম শহর বোম্বাই। কিন্তু ঊষা ভীষণভাবে কলকাতার। ভূমিকন্যা না হয়েও শহর কলকাতার সিগনেচার ঊষা।ল কীভাবে হলেন, সে গল্পে পরে আসা যাবে। আপাতত রানির রথ ছুট শুরু করল কীভাবে সে কথাই চলুক।
সাল ১৯৬৯। এই বছরটা পৃথিবীর বুকে এক ঝোড়ো বছর। তার বদলের ধাক্কায় বদলে যাচ্ছে আগামীর ইতিহাস। এই বছরেই চাঁদে পাড়ি দিয়েছিল মানুষ। চাঁদের বুকে নীল আর্মস্ট্রং। গায়ক জন লেনন আর ইউকো অ্যামস্টারডামে শান্তির বার্তায় চমকে দিচ্ছে গোটা বিশ্বকে। চমক এলো এদেশেও। বছর কুড়ির মেয়েটা ধাক্কা দিতে শুরু করল ভারতীয় গানের দুনিয়ায়। সুরের পালে লাগল ক্যালিপসো, কান্ট্রি, জ্যাজ, পপ আর বিদেশি গানের সুরের দোলা। যে গলা একদিন অন্যরকম হওয়ার অপরাধে বাদ পড়েছিল ক্লাসরুম থেকেই সেই গলাই ক্রমশ হয়ে উঠতে লাগল গানপ্রেমীদের নেশাঘোর।
চেন্নাইয়ের মাউন্ট রোডে স্যাফায়ার থিয়েটার কমপ্লেক্সে নাইন জেমস নাইট ক্লাবের বেসমেন্ট হয়ে উঠল এক ঝড়ের আতুঁড়ঘর। ঊষার গান প্রচন্ড ভাল লেগে গেল দর্শকদের। চেন্নাইয়ের নাইন জেমস জয় করে ঊষা এলেন কলকাতায়। গন্তব্য ট্রিঙ্কাস।
পার্কস্ট্রিটের ট্রিঙ্কাস এক বিনিসুতোয় বেঁধেছিল ঊষা আর কলকাতাকে। তখনও ঊষা জানতেন না কলকাতাই হয়ে উঠবে তাঁর ভবিষ্যৎ। কলকাতা থেকে দিল্লিতে, ওবেরয়দের হোটেলে। চলতে লাগল গান সফর। ইতিমধ্যেই একদিন নাইট ক্লাবে আলাপ হয়ে গেল দেবানন্দের সঙ্গে। বলিউডে পা রাখলেন প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে। তাঁর বিজয় রঠ ছুটল লন্ডন হয়ে আরও অনেক দূর দেহে। কিন্তু ফিরতেই হল কলকাতায়।
ঊষার কাছে কলকাতা এক ভালোবাসার গল্প। প্রথম আসা ১৯৬৯-এ। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়েছিলেন শতক পুরনো এই শহরটার। বোম্বাই-মাদ্রাজের থেকে একেবারে আলাদা এই শহরের গন্ধ। তাই ট্রিঙ্কাস যখন দ্বিতীয়বার চুক্তি করতে চাইল ঊষা খুশিই হয়েছিলেন মনে মনে। ফ্লাইট টিকিট পাঠানো হয়েছিল। বিমানবন্দরে ঊষার অপেক্ষায় তাদের গাড়ি। অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন দুই কর্ণধার জোশুয়া আর পুরি।
তারপর ধীরে ধীরে আরও বেশী জড়িয়ে গেলেন এই শহরের সঙ্গে। কপালের বিন্দিতে লেখা কলকাতার প্রথম অক্ষর ‘ক’। কলকাতা তাঁকে আঘাত দিয়েছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি দিয়েছে ভালোবাসা। ক্ষত ধুয়ে গিয়েছে গানপ্রেমী মানুষের অনাবিল ভালোবাসা। তাই তিনি এই শহরের ঊষা।