আলিপুরদুয়ার জেলার এক ঐতিহ্যবাহী লোকপুজো ভেলাপুজো ও উপড়ানি মা

আলিপুরদুয়ার জেলার মধ্য কামাখ্যাগুড়ি ধামে দেবী কামাখ্যাকে নিয়ে প্রচলিত আছে অজস্র কাহিনী। শোনা যায় রাজা নরনারায়ণের আমলে একবার তিনি মা কামাখ্যাকে স্বপ্নে দেখেন। দেবীর অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে রাজা দেবীর কাছে প্রেমভিক্ষা করেন। দেবী তখন রাজাকে বলেন "যদি এক রাতের মধ্যে আমার জন্য প্রকাণ্ড জলাশয় সমেত প্রাসাদ তৈরি করে দিতে পারেন তবেই আমি এই প্রেম প্রস্তাব গ্রহণ করব"। রাজা দেবীর কথা শুনে রাজি হয়ে যান। তিনি প্রাসাদ নির্মাণের কাজ শুরু করে দেন। কিন্তু রাত কেটে পরের দিন ভোর হয়ে গেলেও প্রাসাদ নির্মাণের কাজ স্বাভাবিকভাবেই শেষ হয়নি। দেবী তখন নরনারায়ণের প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে চলে যান।

স্থানীয় জনশ্রুতি এমন যে শোনা যায় পরবর্তীকালে এক পূজারীর সাহায্যে রাজা একটি মন্দিরে লুকিয়ে নৃত্যরত মা কামাখ্যাকে দেখে ফেলেন। রাজার সঙ্গে ছিলেন সেই পূজারীও। রাগে, অপমানে মা কামাখ্যা সেই পূজারীর গলা কেটে দেন। রাজা নরনারায়ণকে অভিশাপ দেন "আজকের পর থেকে আপনার বংশের কেউ যদি আমার দর্শন করে তাহলে তখনই আপনার বংশ লোপ পাবে।"

এই ঘটনার পর থেকে কোচবিহার রাজবংশের কেউ যখন নীলাচল পাহাড়ের কাছ দিয়ে যেত তখন কামাখ্যাপীঠের জায়গাটুকু নিজেদের শরীর আবৃত করে রাখত। এমনও শোনা যায় পরবর্তীকালে মুসলিম আক্রমণে কামাখ্যা মন্দির ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ‌ কিন্তু কোচবিহার রাজবংশের রাজা প্রাণনারায়ণ মন্দিরটি আবার নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেন। ঐতিহাসিকদের মতে কোচবিহারের রাজবংশের রাজাদের মা কামাখ্যার প্রতি ভক্তি কোন কালেই কমেনি।

মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ একবার শিকারে বের হয়ে ভারী বিপদে পড়েন। হাতির পিঠে চেপে তিনিই শিকার করতে বেরিয়েছিলেন। সেই হাতির পা কাদায় ডুবে যায়। এমন ভাবে কাদায় ডোবে যে কোনভাবেই হাতিটিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। রাজা চিন্তা করতে শুরু করেন, তবে কি শিকারের পরিকল্পনাটাই বাতিল করতে হবে! শোনা যায় প্রিয় হাতির জন্য রাজা রীতিমত দুঃখিত হয়ে পড়েন। এই সময় স্থানীয় এক গুণফল রাজাকে পরামর্শ দেন ওই হাতিটির পা ডোবা জায়গাটায় যদি রাজা দেবী কামাখ্যার মন্দির তৈরি করে দেন তাহলে হাতির পা কাদা থেকে মুক্তি পাবে। রাজা তৎক্ষণাৎ পুজোর আড়ম্বর শুরু করেন। একটি মাটির ঢিবি দিয়ে প্রতিকী মূর্তি তৈরি করে তন্ত্রমতে দেবী কামাখ্যার পুজো শুরু করেন। পরের দিন সকালে রাজা দেখতে পান তার প্রিয় হাতি কাদা থেকে উঠে এসে গাছের পাতা খাচ্ছে। সেই থেকে প্রতিবছর অম্বুবাচীর সময় আদি কামাখ্যা ধাম তৈরি করে কামাখ্যা মায়ের পুজোর প্রচলন শুরু হয়। কামাখ্যা পীঠের বাইরে কোচবিহারে মা কামাখ্যার আরাধনা শুরু হয়। সাধারণত স্থানীয় রাভা সম্প্রদায়ের লোকেরা এই পুজোর পরিচালনার দায়িত্ব নেন। প্রথমদিকে পুজোর সময় রাজকোষ থেকে অর্থ আসত। তবে পরবর্তীকালে ওই অঞ্চলে দেবী কামাখ্যার পুজো বন্ধ হয়ে যায়। জনশ্রুতি এমনটাই যে আগে এই কামাখ্যা ধামের কাছে দেবতারা তাদের রুপোর টাকা শুকাতে দিত।

আরেকটি ঘটনার কথা শোনা যায়। তৎকালীন কোচবিহারের হুজি রাজবর রাভা মারা যান। তার ছেলে লক্ষ্মীন্দর রাভা বংকো রাভাকে সঙ্গে করে গয়া যায় পিন্ড দিতে। বংকো রাভা ঠিক করেন তিনিও পিন্ডদান করবেন। তর্পণ করতে গিয়ে একের পর এক অতিলৌকিক ঘটনা ঘটতে থাকে বংকো রাভার সঙ্গে। প্রথমে বালি থেকে বেরিয়ে আসে দুটো সিঁদুর লাগানো জ্যান্ত পুঁটি মাছ। পুঁটি মাছ দুটোকে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হলে বংকো রাভার পায়ের কাছে আবার এসে তারা ভিড় করে। আবার তার সঙ্গে বংকো রাভার পায়ের কাছে ভেসে আসে একটি সোনার অলংকার। অলংকার জলে ভাসিয়ে দিলে তখন একটা রাধা কৃষ্ণের মূর্তি তার পায়ের কাছে ভেসে আসে। বাড়ি ফিরে বংকো রাভার জ্বর আসে। তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে মা কামাখ্যা ধামের পাশে জঙ্গলে আশ্রয় নেন। কয়েকদিন পরে দেখা যায় বংকো রাভা প্রায় পাগল হয়ে গেছেন। ‌ স্থানীয় কবিরাজ তাঁকে দেখে বলেন তাঁর শরীরে স্বয়ং মা কামাখ্যা ভর করেছেন। কিন্তু স্থানীয় মানুষ কিছুতেই এ কথা বিশ্বাস করতে চায় না। তাঁরা প্রমাণ চান। বংকো রাভা প্রমাণ দেওয়ার জন্য একটি বিশেষ কাঁটা জাতীয় বাঁশ গাছে তিনবার ওঠা-নামা করেন। অথচ একবারও কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয় না তার শরীর। তাঁকে এই অবস্থায় দেখে স্থানীয় মানুষরা বিশ্বাস করেন বংকো রাভার শরীরে সত্যিই মা কামাখ্যা ভর করেছে।

এভাবেই আলিপুরদুয়ার জেলার মধ্য কামাখ্যাগুড়ি আদি মা কামাখ্যা ধামে কামাখ্যা মা এবং অন্যান্য লোকদেবতা ও উপদেবতার পূজো হয়। এখানে লম্বা বাঁশকে লালমানির কাপড়ে মুড়ে মাথায় ত্রিশূল দিয়ে মন্ত্র পড়ে বাঁশ জাগানি গান গাওয়া হয়। পুজোর এক সপ্তাহ থেকে পনেরদিন আগে থেকে চলে মাগন সংগ্রহ। মূলত রাভা সম্প্রদায়ের লোকেরাই এই পুজোর দায়িত্বে থাকেন। মাগন সংগ্রহ করতে যাওয়ার আগে থানে তান্ত্রিক কোচা হুজি দিয়ে তৈরি করানো হয় ভারাল জল। এটি আসলে শান্তি জল। মাটির পাত্রে নদী বা কুয়ো থেকে জল এনে সেই পাত্রে ফুল, তুলসীপাতা, বেলপাতা দিয়ে মন্ত্র পড়ে তৈরি করা হয় এই জল।। শোনা যায় কারণ অসুখ-বিসুখ হলে, রোগ হলে এই জল খেলে নাকি সব রোগ শোক নির্মূল হয়ে যায়। এইজন্যে ওই অঞ্চলের দেবীকে বলা হয় উপড়ানি মা, কারণ দেবী রোগ উপড়ে ফেলতে পারেন।

মা কামাখ্যা ধামে মহামেলার দিন মা কামাখ্যার পুজোর পাশাপাশি আরেকটা পুজো আয়োজন করা হয়। ওই পূজা হয় মন্দিরের বাইরে। এই পুজোর নাম ভেলা পুজো। ভেলা পুজোর জন্য পাঁচটা কলা গাছ দিয়ে ভেলা বানানো হয়। ধানের উপর ছাউনির মতো করে ঘর তৈরি করা হয়। ভেলাকে  কলাসুরের প্রতীক হিসেবে কল্পনা করে নেওয়া হয়। গ্রামের সব রোগব্যাধি, দুর্দশা, অশান্তি মড়ক এসব অশুভ কিছুর জন্য দায়ী এই কলাসুর। তাই কলাসুরের পুজো করা হয়। ভেলা পুজো আসলে ভেলা রূপী কলাসুরের শরীরে উপড়ানি দেবী মা বা মহাদেবের পুজো। ভেলায় স্থাপন করা ঘট হল দেবীর প্রতীক।

এই পুজো কেবলমাত্র রাভা সম্প্রদায়ের তান্ত্রিকরাই করতে পারেন। এই পুজোয় দশটা ফল, কলা, দুধ,দই দেওয়া হয় আর পঞ্চপ্রদীপ জ্বালানো হয়। এই পুজোয় পাঁঠা অথবা পায়রা বলি দেওয়ার প্রথা রয়েছে। পুজোর একদম শেষ পর্যায়ে স্থানীয় ছেলেরা সকলে মিলে লাল আর সাদা শালু কাপড়ে মোড়া বাঁশগুলো হাতে ধরে ভেলাটার চারিদিকে ঘোরে। পুজো শেষে ভেলাটাকে কাঁধে করে নদীতে নিয়ে যাওয়া হয়। এই পুজোর তাৎপর্য হল মহাদেবীর মাধ্যমে কলা সুরের বধ। ভেলার সঙ্গে পুজো শেষে মাগনের বাঁশগুলোকেও বিসর্জন দেওয়া হয়। এখানে উপড়ানি মা সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, উপড়ে ফেলে স্থানীয় মানুষকে ভালো রাখেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...