ময়মনসিংহ জেলার মসুয়া গ্রামের বিখ্যাত জমিদার বংশের আত্মীয় কালীনাথ রায়চৌধুরী ছিলেন নানাশাস্ত্রে পন্ডিত, যে কারনে মুন্সী শ্যামসুন্দর বলেও অঞ্চলে পরিচিতি ছিল তাঁর। স্ত্রী জয়তারা রায়চৌধুরী। এই রায়চৌধুরী দম্পতির সংসার আলোকিত করে এসেছিল পাঁচ পুত্র ও তিন কন্যার। দ্বিতীয় সন্তান- কামদারঞ্জন। কালীনাথের পাঁচ পুত্র আর তিন কন্তার মধ্যে এই কামদারঞ্জনের পরিচয় গিয়েছিল বদলে।
'রায়চৌধুরী' জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী (যাঁদের আত্মীয় ছিলেন কালীনাথ) ছিলেন নিঃসন্তান। এত প্রতিপ্রত্তি নিয়ে সন্তান না হওয়ায় উত্তসূরির চিন্তায় একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিলেন রায়চৌধুরী-জমিদারবাবু। তিনি কালীনাথের কাছে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র কামদারঞ্জন'কে বাঞ্ছা করলেন। কামদারঞ্জনের বয়স তখন ৫। কালীনাথ হরিকিশোরের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন। হরিকিশোরের নিষ্প্রান সংসারে প্রান আসে,আসে কামদারঞ্জন। কালীনাথের দ্বিতীয় সন্তান খাতায় কলমে হয়ে ওঠে নিঃসন্তান হরিকিশোরের সন্তান। সীমাহীন আনন্দে নিজের নামের সঙ্গে অন্তমিল রেখে দত্তকপুত্রের নাম রাখেন- উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
বোধের বিকাশে ‘৫ বছর বয়স’ টা যথেষ্ট বলেই ধরা যেতে পারে, অবএব পূর্বপরিচিত ৫ বছরের আবছায়া স্মৃতিমেদুরতা নিয়ে শিশু উপেন্দ্রকিশোর বেড়ে উঠতে লাগল জমিদার বংশে। উপেন্দ্রকিশোরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আরম্ভ হয় ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে। স্কুলে বেশ জনপ্রিয়তা ছিল তার। বিশেষত ছবি-আঁকিয়ে, বাঁশি-বাজিয়ে, বেহালা-বাজিয়ে হিসেবে। তিনি নাকি সারাদিন বাঁশি আর বেহালা নিয়েই থাকতেন। স্মৃতিমেদুরতার করুণ-গভীর সুর তাঁর মনে বসে গিয়েছিল যে...। সবার ধারণা ছিল, এই ছেলে এন্ট্রান্স পাসই করতেই পারবে না। কিন্তু তিনি ঠিকমত এন্ট্রান্স পাস করে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেন।
তখন হরিকিশোর আর কালীনাথ পরামর্শ করে উপেন্দ্রকিশোরকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন। ১৮৮০ খ্রিঃ প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু পরে ১৮৮৪ সালে মেট্রোপলিটন কলেজ(অধুনা বিদ্যাসাগর কলেজ) থেকে বিএ পাশ করেন।
জ্ঞানী-মুক্তমনা রামমোহন রায় ধর্মীয় সত্য অনুসন্ধানের তৃষ্ণায় তাঁর উদার মন নিয়ে সকল গুরুত্বপূর্ণ ধর্মের শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়নে প্রণোদিত হন। এভাবে তিনি শুধু সংস্কৃত ভাষায় হিন্দু ধর্মশাস্ত্রসমূহ অধ্যয়ন করেই ক্ষান্ত হন নি; তিনি আরবি ভাষায় কোরান, হিব্রু ভাষা ও গ্রিক ভাষায় বাইবেল পাঠ করেন। বিভিন্ন ধর্ম অধ্যয়ন তাঁর মনে দৃঢপ্রত্যয় জন্মায় যে, যেহেতু প্রত্যেক ধর্মেরই উদ্দেশ্য অভিন্ন - মানব জাতির নৈতিক পুনর্জাগরণ, তাই পরিবর্তিত সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রত্যেক ধর্মের পুনর্ব্যাখ্যা ও পুর্নমূল্যায়ন প্রয়োজন এবং এই চিন্তা করে তিনি দেখলেন যে, শুধু তাঁর পক্ষে নয়, কারো পক্ষেই নিজ-নিজ ধর্ম ত্যাগ করে অন্য কোনও ধর্ম গ্রহণের পেছনে কোন যুক্তি খাড়া করা যাচ্ছেনা। তিনি প্রত্যেক ধর্মের গোঁড়ামি, শাস্ত্রীয় আচারবিধি ও কুসংস্কার বাদ দিয়ে সর্বজনীন নৈতিক উপদেশাবলি তৈরী করেন। কিছুদিন যাবৎ অনেকটা অন্ধের মতো অবসন্ধানের পর তাঁর ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা কিছুটা স্পষ্ট রূপ লাভ করে। ১৯ শতকের গোড়ায় ১৮২৮ সালের আগস্ট মাস নাগাদ রাজা রামমোহন রায় এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা মিলে সমাজ ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে এক আন্দোলনের নির্দশনস্বরূপ ব্রাহ্ম সভা (পরবর্তীসময়ে ব্রাহ্ম সমাজ) অর্থাৎ নিরাকার ঈশ্বরের সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজজীবনে সেই কলুষহীন নিরাকার ঈশ্বর-ধর্মের সন্ধান পেয়ে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন উপেন্দ্রকিশোর। যদিও তাঁর এই দীক্ষা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর গোঁড়া হিন্দু-ব্রাহ্মণ পরিবার।
ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হওয়ার সূত্রে তাঁর সাথে পরিচিতি হয় ব্রাহ্মসমাজের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এবং দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে দেবেন্দ্রনাথের পুত্র রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। সেই সূত্রেই তাঁর যাতায়াত শুরু হয় জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে। তরুণ বয়স, নতুন কিছু জানার বিষয়ে প্রবল উৎসাহে পদে পদে উজ্জীবিত হন তিনি। কলকাতায় এসে নানা বিষয়ভাবনার নতুন নতুন বই পড়ার সুযোগ পেয়ে তার মধ্যে ডুবে যান তিনি। ছাত্রাবস্থায় ১৮৮৩ খ্রিঃ 'সখা' পত্রিকায় উপেন্দ্রকিশোরের প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু তার পর পরই উপেন্দ্রকিশোর লক্ষ্য করেন, এ দেশে ছোটদের জন্য ভাল লেখা-আঁকা ছাপা বই নেই। সেই ভাবনার সূত্রেই শিশু ও কিশোরদের উপযোগী বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখায় মনোনিবেশ করলেন তিনি।
এসবের মধ্যেই ১৯৮৫ সালে ব্রাহ্মনেতা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে বিধুমুখী দেবী'কে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের পরে ওঠেন ১৩ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাসায়। বিয়ে তো করেছেন কিন্তু সংসার চালাবেন কি দিয়ে! ছবি এঁকে আর ফটোগ্রাফি করে রোজগার করতে শুরু করেন উপেন্দ্রকিশোর। তবে মনে মনে ছোটদের জন্য আঁকা-লেখা সহ বই ছাপানোর সেই ইচ্ছেটাকে জাগিয়ে রেখেছিলেন তিনি। সেইমত নিজের লেখা আর আঁকা দিয়ে সচিত্র বই ছাপানোর জন্য খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে প্রস্তত করে নেন এনগ্রেভিং সম্পর্কে। বিলেত থেকে ছাপার আধুনিক যন্ত্র আনাবার ব্যবস্থা করলেন। ১৮৯৫ খিঃ সুরু হয় নিজের প্রেস। তাঁর হাত ধরে এভাবেই এদেশে সূত্রপাত হয়েছিল মুদ্রণশিল্পের এক নতুন অধ্যায়ের।
ততদিনে জন্ম নিয়েছে উপেন্দ্রকিশোর-বিধুমুখীর দুই ছেলে-তিন মেয়ে: সুখলতা, সুকুমার, পূণ্যলতা, সুবিনয় ও শান্তিলতা। নিজের প্রেসের নামকরণ করেন- ইউ রায় অ্যান্ড সন্স। এভাবে ছবি আঁকা, ছবি তোলার স্টুডিও হয়, আরও নানা উপকরণে সুসজ্জিত হয় উপেন্দ্রকিশোরের প্রেস। লেখা ও ছবি আঁকার পাশাপাশি চলতে থাকে হাফটোন ছবি ছাপার বিষয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এ সম্পর্কে তাঁর রচিত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় বিলেতের ম্যাগাজিন 'পেনরোজ অ্যানুয়েল'এ। প্রশংসিতও হয় সেইসব রচনা। তেল রঙ বা জল রঙ-এর হাফটোন ছবি ছাপার বিষয়টি যখন বিদেশে গবেষণার পর্যায়ে, উপেন্দ্রকিশোর এদেশে নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে তাঁর প্রেসে ছাপানোর কাজ শুরু করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইউ রায় অ্যান্ড সন্স কোম্পানি থেকেই ভারতবর্ষে 'প্রসেস' শিল্পবিকাশের সূত্রপাত হয়।
১৯১৩ সালে উপেন্দ্রকিশোরের সম্পাদনায় বিখ্যাত ‘সন্দেশ’ পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হতে শুরু করে। আর এই সন্দেশের হাত ধরেই তাঁর তো বটেই, আসে তাঁর পুত্র সুকুমার রায়ের হাতিমি, বকচ্ছপ, হাঁসজারুসহ যাবতীয় শিশুসাহিত্য। এমনকি পৌত্র- সত্যজিতের প্রায় সব শিশুদের-কিশোরদের রচনাও এই সন্দেশেই প্রথম ছাপা হয়। প্রথম জীবনে জীব-জন্তু কীট-পতঙ্গ নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে লিখতে নিজেকে না খুঁজে পেয়ে, ছোটদের জন্য লিখতে শুরু করেন তিনি। তাঁর লেখা মুক্তমনস্ক শিশুপাঠ্য ‘ছেলেদের রামায়ণ’ আর ‘টুনটুনির বই’ বহুল সমাদৃত। সত্যজিতের ছবি 'গুপি গায়েন বাঘা বায়েন'-এর রয়য়িতা তিনিই। তাঁর মনের মতো করে ছোটদের জন্য লিখে-এঁকে গিয়েছেন গল্প, নাটক, রূপকথা, উপকথা, বিজ্ঞান-প্রবন্ধ, ছড়া- স-অ-ব। 'ছোটদের' লেখক তকমাধারী হলেও, গুঢ় মনস্তত্ত্ব-সমাজবিজ্ঞানে পরিপূর্ণ ছিল তাঁর প্রতিটি কাজ।
বারবার বাড়ি বদলে উপেন্দ্রকিশোর শেষমেশ থিতু হয়েছিলেন ১০০ নম্বর গড়পার রোডের বাড়িতে। সেটিই ছিল তাঁর নিজের বাড়ি, এই বাড়ির নকশাও নিজেই করেছিলেন। এই বাড়িতেই জন্মেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তবে নিজের এই বাড়িটিতে উঠতে না-উঠতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। কলকাতার বাঘা-বাঘা সব ডাক্তারদের দেখানো হলেও লাভ হলো না কিছুই। ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় মারা যান শিক্ষা-সাহিত্য-বিজ্ঞান-ছবি-ছাপা-সঙ্গীত-ছোটদের-বড়দের-সবার সর্বক্ষেত্রের অন্যতম রূপকার-অবিস্মরণীয় অগ্রণী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।