নাম ছিল কামদারঞ্জন রায়। পাঁচ বছর বয়সে তাঁকে দত্তক নেন হরিকিশোর রায়চৌধুরী এবং লক্ষ্মী দেবী। হরিকিশোর তাঁর নিজের সঙ্গে নাম মিলিয়ে নাম রাখেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ।
উপেন্দ্রকিশোরের জন্মদাতা কালীনাথ রায়। তাঁর আট সন্তানের মধ্যে কামদারঞ্জন ওরফে উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন তৃতীয়।
বাংলাদেশের মসুয়া গ্রামের শিক্ষিত অভিজাত পরিবারের কালীনাথ রায় ছিলেন পণ্ডিত মানুষ। বহুভাষায় তাঁর দক্ষ। সেই ধারা ধারণ করে ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরও। পালক পিতা হরিকিশোর, সম্পর্কে রায় পরিবারের আত্মীয় ছিলেন। দীর্ঘদিন সন্তান না হওয়ায় দত্তক নেন পাঁচ বছরের কামদাকে।
ছাত্র অবস্থা থেকেই ছোটদের জন্য লেখালিখি শুরু করেছিলেন। নিজের বইতে তিনি নিজেই ছবি আঁকতেন।
পুত্র সুকুমার রায় পিতার সম্পর্কে লিখেছেন, ‘লঘুভাবে কোন কার্যে প্রবৃত্ত হওয়া তাঁহার প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল, যখন যাহাতে হস্তক্ষেপ করিতেন তাহারই সাধনায় একেবারে নিমগ্ন থাকিতেন।’
এই স্বভাব তাঁর চিরকালীন। তাঁর লেখা প্রথম বই ‘ছেলেদের রামায়ণ’ যখন প্রথম প্রকাশিত হল তখন সাধারণ মানুষের কাছে সেই সাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় হলেও তাঁর নিজের অতৃপ্তি ছিল বইয়ের মুদ্রণ নিয়ে। সেই তাগিদ থেকেই ১৮৮৫ সালে বিদেশ থেকে নিজের খরচে তখনকার দিনের আধুনিকতম মুদ্রণযন্ত্রাংশ নিয়ে আসেন। ৭ নম্বর শিবনারায়ণ দাস লেনে নতুন ভাড়াবাড়ি নিয়ে ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ নামে নতুন ছাপাখানা খোলেন। হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরিক্ষাও করেন।
ছেলে সুকুমারকে বিলেতে পাঠিয়েছিলেন মুদ্রণ নিয়ে আরও অভিজ্ঞতার জন্য। মুদ্রণ-এর ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশে রেনেসাঁ এনেছিলেন বলা যায়। ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ সেই সময়ের নাম করা প্রকাশনা সংস্থা হয়ে উঠেছিল। টুনটুনির বই’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’‘ছেলেদের মহাভারত’ ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছিল এখান থেকে। প্রকাশিত হত সন্দেশও।
শিবনারায়ণ দাস লেনের ডার্ক রুমে বসে দিনের পর দিন গবেষণা চালিয়ে গিয়েছেন মুদ্রণ নিয়ে। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল মুদ্রণ নিয়ে তাঁর তথ্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধ। সারা বিশ্বের মুদ্রণ শিল্প ঋদ্ধ হয়েছিল তাঁর ভাবনায়।
ছাপাখানার একটা ঘর ছিল তাঁর স্টুডিও। সেখানেই আঁকা-লেখার কাজ করতেন। জলরঙে বা তেলরঙে ছবি এঁকেছেন। ছবি আঁকার অভ্যাস তাঁর ছোট থেকেই ছিল আত্মস্থ হয়ে যেতেন রং-তুলির সামনে। পুত্র সুবিমল রায়ের স্মৃতিতে, কী শান্ত, সজীব আনন্দময় সে চেহারা। গিরিডিতে শালবনের দিকে তাকিয়ে তিনি যখন ছবি আঁকতেন তখন তাঁকে দেখে মনে হত যেন তপোবনের একজন মুনি।”
এক সময় রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে বেহালা বাজাতেন উপেন্দ্রকিশোর। দীর্ঘদিন উচাঙ্গ সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ব্রাহ্ম সভায় গান করতেন। ছয়টি ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। টাউন হলের ঐতিহাসিক অধিবেশনেও রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সঙ্গে বেহালা বাজিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর।
তাঁর ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ নিয়ে নানা গল্প আছে। এক সময় ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য পালক পিতা ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেছিলেন উপেন্দ্রকিশোরকে। তাঁর মৃত্যুর পর মা রাজলক্ষ্মী দেবী সেই উইল ছিড়ে ফেলে দেন। সমস্ত সম্পত্তি পুত্রদের মধ্যে সমানভাগে ভাগ করে দিয়েছিলেন।
লেখায়- রেখায়- সুরে- শিল্পের সব মাধ্যমেই বহুমুখী উপেন্দ্রকিশোর তাঁর নিজস্ব ছাপ রেখে গিয়েছিলেন। তাঁর প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, “উপেন্দ্রকিশোরের বহুমুখী প্রতিভার বিচার করার ক্ষমতা তখন ছিল না। সেটা সম্ভব হয়েছিল আরও পরিণত বয়সে। তখন বুঝেছিলাম যে শিশুসাহিত্য রচনায়, কাহিনির ইলাস্ট্রেশনে, সঙ্গীত রচনায় এবং প্রাঞ্জল ভাষায় জটিল বৈজ্ঞানিক তথ্য বর্ণনে ও বিশ্লেষণে তাঁর সমতুল্য এদেশে কমই আছে।”