সত্যি কি কাউকে অভিনয় শেখানো যায়? কি বলছেন টলিউডের অ্যাক্টিং কোচেরা?

রুপোলী পর্দায় আসতে চান অনেকেই!  শহর থেকে মফস্‌সল, বহু জায়গা থেকেই অভিনয় জগতে পা রাখেন সাধারণেরা। তাঁদের জন্যই এখন তৈরি হচ্ছে ‘অ্যাক্টিং স্কুল’। অভিনয় শেখানোর জন্য এই স্কুল হয়ে উঠছে সকলের মাথার ছায়া। সেই  কারণে ফলাও করে চলছে তার বিজ্ঞাপন এবং প্রচার। দেখা যাচ্ছে কোর্স করলেই ইন্ডাস্ট্রিতে মিলবে ‘সুযোগ’। কিন্তু এটা তো হয় বর্তমানে। একটা সময় ছিল যখন অভিনেতা তৈরি হত মঞ্চ থেকেই। কিভাবে তাঁরা অভিনয় শিখতেন? তাঁরা শিখতেন অগ্রজদের অভিনয় দেখে।  

কিন্তু প্রসঙ্গ উঠলেই মনে একটা প্রশ্ন আসতেই থাকে। সত্যি কি কাউকে অভিনয় শেখানো যায়? নিয়মমাফিক ভাবে একজন সাধারণ ব্যক্তি কি অভিনেতা হয়ে উঠতে পারেন? এই প্রশ্নের উত্তরে কি বলছেন টলিপাড়ায় অভিনেত্রীরা? 

small_thumb3x331

প্রথমেই আসা যাক টলিপাড়ার এক অন্যতম শক্তিশালী অভিনেত্রীর কাছে, তিনি সুদীপ্তা চক্রবর্তী। অভিনয় জগতে তো রয়েইছেন তার পাশাপাশি বিগত তিন বছর ধরে নিজের অ্যাক্টিং স্কুল চালাচ্ছেন সুদীপ্তা। সেখানে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের অভিনয় প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন নিজেই। তিনি প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন যে তাঁর মতে অভিনয় জিনিসটা নিজের মধ্যে থাকতে হবে। উদাহরণ দিয়ে বলেছেন যে কেউ খুব ভালো হাসতে পারেন। প্রথম বারে অনেকেই কিন্তু হাসতে পারবেন। কিন্তু পরিচালক দশটা রিটেক নিলে তখন দশ বার ওই হাসিটা হাসার জন্য অনুশীলনের প্রয়োজন। 

তাঁর মতে সব চরিত্র এক হয়না, অজানা চরিত্রে অভিনয় করতে গেলে তখন প্রশিক্ষণ কাজে আসে। তিনি আরও জানালেন যে কোনও হিট কাজ করার পর হাতে কাজ নাই থাকতে পারে, তবে সেই কঠিন সময়ে নিজেকে ধরে রাখার পদ্ধতিও তিনি শিখিয়ে রাখেন তাঁর ছাত্র ছাত্রীদের।   

অভিনেত্রী এবং নাট্যকর্মী সোহিনী সেনগুপ্ত। দীর্ঘ দিন ধরে নতুনদের তৈরি করছেন তাঁর অ্যাক্টিং স্কুলে। তাঁর মতে প্রশীক্ষণের মাধ্যমেও অভিনয় শেখা যায়। তিনি প্রথমেই জানালেন যে নটী বিনোদিনীকে তো কেউ অভিনয় শেখাননি। কিন্তু উনি মন দিয়ে অসাধারণ অভিনয় করতেন। অভিনেতার কাছে এই মনটাই হল তাঁর মূল অস্ত্র। সোহিনীর মতে, অভিনেতার অভিনয় তাঁর আবেগপ্রবণ এবং বুদ্ধিদীপ্ত মনের উপর নির্ভর করে। আর সেটাই ছাত্রদের সাথে ওয়ার্কশপের মাধ্যমে প্রাথমিক ভয়টা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

তিনি উদাহরণ দিয়ে জানালেন যে কোনও বাচ্চা মেয়ে হয়তো আগে কোনও দিন জোরে হাসেনি। কিন্তু ওয়ার্কশপের মাধ্যমে তাকে সেই হাসিটা শেখানো সম্ভব। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও অভিনয় ক্ষমতাকে আরও উন্নত করা সম্ভব। অভিনেতার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়ে যখন স্কিল শিখে নেওয়া যায়, ফলে সময়ের সঙ্গে সেটা তাঁর অভিনয়কেও প্রভাবিত করবে মনে করেন অভিনেত্রী।

আজকাল প্রতিষ্ঠিত অভিনেতারা কোনও ছবির শুটিংয়ের আগে ওয়ার্কশপ করে নিচ্ছেন। কেন? এই বিষয়ে সুদীপ্তা জানিয়েছেন যে এখন ছবির শুটিং হয় দশ দিনে! ফলে সেখানে অভিনেতার প্রস্তুতি বা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো সময় কারও নেই। তাই তারা আগে থেকে তৈরি হয়ে ফ্লোরে যেতে চাইছেন। সেখানে ওয়ার্কশপ কাজে আসে। তাঁর মতে এটা সকলের জন্য খুবই ভাল বিষয়।

অভিনেত্রী সুদীপ্তা মনে করেন যে অভিনয় করা সহজ মনে হলেও সেটা মোটেই সহজ নয়। কারণ এই অভিনয়ের পেছনে দরকার দীর্ঘ পরিশ্রম এবং অধ্যাবসায়। তাঁর মতে একটা বয়সের পরে নিজের ইচ্ছে ছাড়াও কোনও কিছু শেখা একেবারে অসম্ভব।    

সম্প্রতি ‘ছোটলোক’ ওয়েব সিরিজে দেখা গিয়েছে দামিনী বেণী বসুকে। তিনি এখন হয়ে উঠেছেন দর্শকদের কাছে এক পরিচিত মুখ। টলিউডের পাশাপাশি বলিউডেও বিভিন্ন কাজ করেছেন।

অভিনয়ের পাশাপাশি দীর্ঘ দিন ধরেই টলিপাড়ায় অভিনয়ের ওয়ার্কশপ করাচ্ছেন দামিনী। দামিনী জানিয়েছেন যে প্রশিক্ষণেরও বিভিন্ন আঙ্গিক আছে। তিনি জানিয়েছেন যে এনএসডির স্ক্রিনিং টেস্ট এবং আইআইএম-এর কোনও ছাত্রের প্রেজেন্টশনের ওয়ার্কশপ একেবারে আলাদা। তবে উভয় ক্ষেত্রেই ব্যক্তি যাতে আরও ভাল পারফর্ম করতে পারেন, সে দিকে জোর দেওয়া হয়। তাঁর মতে নতুনদের শেখাতে গেলে থিওরি এব‌ং প্র্যাকটিকাল, এই দু’ভাবেই শেখাতে হয়। এক জন পেশাদার অভিনেতাকে কোচ করতে গেলে তাঁর অ্যাপ্রোচটা আলাদা হবে।

অন্যদিকে, দামিনীর বিশ্বাস যে সবাই ‘পারফর্ম’ করতে পারেন। অভিনয়ের সব খুঁটিনাটি দিকগুলি প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই রপ্ত করা একেবারে সম্ভব। তবে তিনি জানিয়েছেন যে সেখানে একটা শর্ত রয়েছে। সেটা হল ‘সে কি শিখতে চায়?’এটা সবথেকে আসল একটা প্রশ্ন। তাঁর মতে কেউ যদি শিখতে চায়, তা হলে সে নিশ্চয়ই সময়ের সঙ্গে শিখে নেবে। অভিনয় জগতে কেউ আসেন নিজের ইচ্ছায়, আবার কেউ আসেন পরিস্থিতির চাপে পড়ে। ফলে দামিনী এই বিষয়ে জানিয়েছেন যে কেউ যদি পরিবারের চাপে বা প্রযোজকের চাপে অভিনয় শিখতে এসে থাকে তাহলে সে খুব বেশি দূর এগোতে পারবে না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে সে হয়তো অন্য কিছু হতে চায়। তাই আগে নিজেকে বুঝতে হবে তার মনের ইচ্ছেটা।

দামিনী আরও জানালেন যে বর্তমান যুগে মানুষের হাতে সময় খুব কম। যা শিখবে সবটাই চটজলদি শিখে নেবে। কিন্তু দামিনী এই প্রসঙ্গে জানিয়ে দিয়েছেন যে চটজলদি অভিনয় শেখা মোটেই সম্ভব নয়। তাঁর কথায় ক্লাসে আসবে না অথচ শুধুই সার্টিফিকেট চাই! এই ভাবে ওয়ার্কশপ করে কখনও অভিনয় শেখা সম্ভব নয়।

অন্যদিকে, ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘ দিন অভিনয়ের ওয়ার্কশপ করাচ্ছেন বর্ষীয়ান অভিনেত্রী-নির্দেশক সোহাগ সেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে অভিনয় শেখা সম্ভব, তবে শেখানো সম্ভব নয়।

এই বিষয়ে সোহাগ স্পষ্ট জানিয়েছেন যে তাঁর কাছে অভিনয় এক ধরনের বিজ্ঞান। তাই একটু বুদ্ধি দিয়ে নিয়মগুলো অনুসরণ করলে একটা পর্যায় পর্যন্ত অভিনয় করা সম্ভব।

তিনি আরও জানিয়েছেন যে সুঅভিনেতা হয়ে ওঠার চাবিকাঠি হল যে অভিনেতা নিজে কতটা বুঝতে পারছেন আর কতটা গ্রহণ করতে পারছেন, পুরোটাই তাঁর ওপর নির্ভর করছে।

এই বিষয়টায় একমত অভিনেত্রী সোহিনী। তিনি ‘নান্দীকার’-এ ছাত্র ছাত্রীদের ছয় মাসের বেশিক ওয়ার্কশপ করান। তিনি জানালেন যে তাঁরা অনেকেই দেখেন যে অনেকেই ক্যামেরার সামনে লুক নিয়ে মাথা ঘামায়। সেটা অভিনয়ের ওপর অনেকটা প্রভাব ফেলে। এটা কাটিয়ে ওঠা খুবই প্রয়োজন।

সোহিনী জানিয়েছেন যে তাঁরা প্রথম তিন মাস মোবাইল থেকে দূরে থাকা, এসি ছাড়া প্র্যাকটিস, সারা দিনের খাবার সঙ্গে রাখা এবং দিনের শেষে নিজের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে অভিনেতার কাঠামো তৈরির চেষ্টা করায়। এরপর পরবর্তী তিন মাসে থাকে থিওরি, লাইট, সেট, মেকআপের প্রশিক্ষণ শেখানো হয়। সোহিনী নিজের মত প্রকাশ করে বলেছেন যে তাঁর মতে একজন অভিনেতা হচ্ছেন স্ট্রাগলার!  অভিনয়ের বিভিন্ন কৌশল শিখতে এক জন অভিনেতার সারা জীবন পর্যন্ত লাগতে পারে, কারণ প্রতিদিন অভিনয়ের মাধ্যমগুলোও বদলাতে থাকে। তাই মন শক্ত করে শেখার প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে সকলকে।

‘অ্যাক্টিং স্কুল’-এর মাধ্যমে অভিনয় শেখা যায়। এই কথা জানিয়ে দিলেন টলিউডের সমস্ত অ্যাক্টিং কোচেরা। তবে, তাঁরা এটাও জানালেন যে এই ‘শেখা’ মোটেই অল্প সময়ে হয় না, দীর্ঘ দিনের শেখার পরে তবেই ভালো অভিনেতা হওয়া যায়।  

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...