ঢাকে কাঠি পড়ে গেছে। চারদিকে থিম পুজোর সেই রমরমা মেতে উঠেছে বাংলা। তবে, বনেদি বাড়ির পুজোগুলো নিয়েও রয়েছে এক আলাদা রমরমা। সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও সাবেকিয়ানার কথা মনে করিয়ে দেয় এই বাড়িগুলি।
আজকে আমরা চলে যাব বর্ধমান শহরের অনতিদূরে সাটিনন্দী গ্রামের সুপ্রাচীন ‘নাগ পরিবার’-র চার শতাধিক বছরের পুরনো দুর্গাপুজোর কথা শুনতে।
এই পরিবারের দুর্গোৎসবের সঙ্গে আজও জড়িয়ে আছে চন্দ্রগুপ্তের সময়কার প্রাপ্ত এক রৌপ্য মুদ্রা। এলাকার মানুষদের কথা অনুযায়ী, পুজোর সময় ভক্তিভরে মায়ের কাছে মনস্কামনা জানালে মা কখনও নিরাশ করেন না ভক্তদের।
এই পুজোর ক’টা দিন নাগ পরিবারের দ্বার সাধারণ মানুষদের জন্য সবসময় খোলা থাকে।
বর্ধমান শহর থেকে প্রায় ১৮কিমি দূরে গেলেই পড়বে এই সাটিনন্দী গ্রাম। এই গ্রামের নাগ পরিবারে মা দুর্গা পূজিত হন ‘হরগৌরী’ রূপে।
এখানে দেবী কিন্তু দশভূজা রুপে আসেন না। অসুরনাশিনী, মহিষাসুরমর্দিনী রুপেনয়। তিনি আসেন দুই হাতে। এক হাতে বরাভয় মুদ্রা আর অন্য হাতে পদ্ম।
এখানে দেবীর ডান পাশে অধিষ্ঠান করছেন দেবাদিদেব স্বয়ং শিব। দেবী এখানে সিংহবাহিনীও নন। তিনি অধিষ্ঠান করছেন শিবের বাহন নন্দীর (ষাঁড়) পিঠে। তাঁর চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে আসেন— লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ।
দেবী ‘উমা’-কে তাঁর দায়িত্ববান স্বামী, স্বয়ং দেবাদিদেব তাঁর বাহনে করে চার ছেলেমেয়ে-সহ উমাকে পৌঁছে দিচ্ছেন তাঁর বাপের বাড়ি। একচালার এই দেবীমূর্তির মুখে স্পষ্ট হয়ে আছে বাংলার আদরের মেয়ে উমার আদুরে মুখচ্ছবি।
নাগ পরিবারের প্রবীণতম সদস্য দেবনাথ নাগের মুখ থেকে জানা যায় যে এই হরগৌরী পুজো তাঁদের পরিবারের প্রায় চার শতাধিক বছরের পুরনো। এই পুজোর সূচনা কবে হয়েছিল এটা সুদূর অতীতে গেলেও জানা যাবে না।এই পুজো নিয়ে নাগ পরিবার এবং সাটিনন্দী গ্রামের মানুষদের উৎসাহে আজও মেতে ওঠে।
আগে এই নাগ পরিবারের পারিবারিক ব্যবসা ছিল মশলা সরবরাহ এবং পাথরের বাসন তৈরির। শোনা যায় এই ব্যবসার সূত্র ধরেই সেই মুঘল যুগ থেকে নিবিড় যোগাযোগ ছিল সব বড় মানুষদের সাথে। এই হরগৌরী পুজোয় বহু রাজপরিবারের সদস্যরা শামিল হতেন।
জানা গিয়েছে যে অতীতে মাটির তৈরি বিশাল ঠাকুর দালান ছিল। তবে, কালের নিয়মে একদিন তা কংক্রিটের হয় ও বর্তমানের ঠাকুর দালানের রূপ পায়।
দুর্গা পুজোর সম্পূর্ণ নিয়ম মেনে ষষ্ঠীতে বোধনের পর সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী-দশমী চারদিন ধরে ধুমধামের সঙ্গে চলে মায়ের পুজো।
নাগ পরিবারের বর্তমান সদস্যরা কর্মসূত্রে এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকলেও পুজো ক’টা দিন সবাই মিলিত হন এক জায়গায়।
তবে, এক বিশাল ব্যাপার হল, এই নাগ পরিবারের সংগ্রহে আছে একটি অতি মূল্যবান বস্তু। সেটা হল চন্দ্রগুপ্তের সময়কার একটি রৌপ্য মুদ্রা।
এই মুদ্রা পুজো করেই শুরু হয় মায়ের পুজো। তারপর, দশমীর দিনে এই মুদ্রা দিয়েই মায়ের যাত্রা বাঁধা হয়। বহু যুগ ধরে মেনে আসছে নাগ পরিবারের হরগৌরী পুজোর এই রীতি। এক সময় পুজো উপলক্ষ্যে পশুবলির প্রচলন ছিল। কিন্তু একবার সেই বলিতে বাধা পড়তে, এখন আখ ও চালকুমড়ো বলির মাধ্যমেই সম্পন্ন হয় মায়ের পুজোর বলিদান।
নাগ পরিবারের নবীন সদস্য অরিত্র নাগ তাঁদের এই পুজোর আরেকটি বৈশিষ্টের কথা জানিয়েছিলেনম, তিনি বলেন এখানে মায়ের ভোগে অন্নভোগ নিবেদনের কোনও রীতি নেই। এই রীতিটিও চলে আসছে পুজোর শুরু থেকেই।
নাগ পরিবারের এই হরগৌরী পুজো একেবারে ঐতিহ্য আর বনেদিয়ানায় মোড়া। এই পুজোয় আনন্দে মেতে ওঠে সাটিনন্দী গ্রামের সমস্ত মানুষ। দেখা যায় দূর দূরান্ত থেকেও মানুষ আসেন এই পূজো দেখতে। কথিত আছে মায়ের কাছে ভক্তিভরে কোনও মনস্কামনা জানালে তা পূরণ হবেই।
বনেদি বাড়ি এখন আর দেখা যায় না। তবে, রয়ে গিয়েছে শুধু বনেদিয়ানা। এই পুজোর কদিনের জন্যে হলেও আমাদের নিয়ে চলে যান অতীতে। একত্রিত করেন পরিবারের সবাইকে এক ছাদের তলায়। এই বনেদি বাড়ির পুজোর সেই ইতিহাস আজও আমাদের মাতিয়ে রাখেন সবসময়।