শুধু সিনেমায় নয়, বাস্তবে এখনও অস্তিত্ব রয়েছে বেশ কিছু রহস্যময় নির্জন দ্বীপ ও উপজাতিগোষ্ঠীর, যেখানে-যাদের অভ্যন্তরে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারেনি বাকি বহির্বিশ্বের আধুনিকীকরণ। সভ্যতার সঙ্গে দুরত্ব বজায় রাখাতেই বিশ্বাসী তারা এবং হাজার হাজার বছর ধরে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বিচ্ছিন্ন হয়ে সংগ্রামী জীবনই বেছে নিয়েছে তারা। আমরা অনেকেই জানি অথবা জানিনা আমাদের বঙ্গোপসাগরের বুকেই বেঁচে রয়েছে সেরকমই একটি নির্জন 'নিষিদ্ধ' দ্বীপ- সেন্টিনেল।
জলসীমা এবং ভৌগোলিক সীমারেখার মানদণ্ডে এই দ্বীপটির অবস্থান ভারতেই। কিন্তু ভারত সরকার শত চেষ্টা করেও এই দ্বীপে তাদের প্রবেশাধিকার আদায় করতে পারেনি। শেষমেশ বাধ্য হয়েই ভারত সরকার কর্তৃক আইন করে দেওয়া হয়েছে, ‘লেট দেম লিভ অ্যালোন’ অর্থাৎ তাদেরকে তাদের মতো করেই বাঁচতে দেওয়া হোক। তাদের নির্জনতা, গোপনীয়তা, রহস্যময়তা, স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা ভঙ্গ করার কোনা অধিকার কেউই রাখে না, তা যদি করার চেষ্টা করা হয় তাহলে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গন্য করা হবে। শুধু ভারত সরকারই নয় সেই দ্বীপের বাসিন্দারাও সে অধিকার কাউকেই দিতে চায় না। তারা নিজেই রাজা তাদের নিজের রাজত্বে।
তবে এই দ্বীপের সন্ধান পাওয়া গেলেও, দ্বীপটি সম্পর্কে পাওয়া যায়নি জানা যায়নি বিশেষ কোনো তথ্য। নৃতাত্ত্বিকদের মতে, দ্বীপটির বয়স প্রায় ৬০ হাজার বছর। আয়তন ৭২ বর্গকিলোমিটার। ভারত সরকার বহুবার চেষ্টা করেও এ দ্বীপটিতে ঢুকতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের এলাকায় কেউ ঢুকতে গেলেই সেখানকার অধিবাসীদের হিংস্রতার শিকার হতে হয়। ভুল করে, দুর্ঘটনার কারণে, বা পথ হারিয়ে কেউ সেখানে প্রবেশ করলে তাদেরকে হত্যা করা হয় নৃশংসভাবে। এমনকি হেলিকপ্টারও সেখানে ল্যান্ড করতে সাহস পায় না। জাতিতে এরা 'সেন্টিনেলি'। সেন্টিনেলিরা বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বসবাসরত আদিবাসী আন্দামানি জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। গ্রেট আন্দামানের উত্তর সেন্টিনেলি দ্বীপপুঞ্জে এই জনগোষ্ঠীর বাস; তাই তাদেরকে সেন্টিনেলি বলা হয়। ধারণা করা হয় প্রস্তর যুগ থেকে এই দ্বীপে তাদের বসবাস চলে আসছে। বহিরাগতদের ওপর আক্রমণাত্মক মনোভাবের জন্য তারা বিশেষভাবে পরিচিত। দ্বীপে হেলিকপ্টার নামলে, নৌকা, জাহাজ ভিড়লে তারা দৌড়ে গিয়ে তীর-ধনুক দিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়।
আধুনিক সমাজের সঙ্গে এঁদের যোগ স্থাপনের চেষ্টা অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। তার আভাস পাওয়া যায়, মার্কোপোলোর একটি লেখায় এই দ্বীপের উল্লেখ থেকে। (যদিও আদৌ তিনি ওই দ্বীপে নেমেছিলেন কি না তা নিয়ে ধন্দ আছে ইতিহাসবিদদের।) জানা যায়, ১৮৮০ সালে ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ এম ভি পোর্টম্যানের নেতৃত্বে একটি দল ওই দ্বীপে যান। কিন্তু বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ স্থাপনের বদলে তাঁরা উপজাতিদের মধ্য থেকে এক প্রৌঢ় দম্পতি এবং চার শিশুকে তুলে নিয়ে আসেন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। উদ্দেশ্য ছিল আধুনিক সমাজের সঙ্গে তাঁদের মেলবন্ধন। কিন্তু আধুনিক সমাজে মানাতে না পেরে রোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই মারা যান তাঁরা। এই ঘটনার পর আধুনিক-সভ্য সমাজের প্রতি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সেন্টিনেলিরা।
মূলত একটি শিকার-নির্ভর জাতি এরা। প্রয়োজনীয় উপকরণ শিকার, মাছ ধরা ও বন্য লতাপাতার সংগ্রহ করে জীবননির্বাহ করে তারা। কৃষিকাজ করার কোনও প্রমাণ মেলেনি এখনও পর্যন্ত। এদের কুড়েঘরগুলোর কোনো দেয়াল নেই, শুধু মাথার ওপর ছাউনিটি মাটি পর্যন্ত প্রসারিত করা হয়। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো আজও এরা হয়তো আগুন জ্বালাতে শেখেনি। নৌকা বা হেলিকপ্টার থেকে বছরের পর বছর নজর রেখে তাদের সম্পর্কে একেবারেই অল্প এই ধারণাগুলি পেয়েছেন নৃতত্ত্ববিদেরা। এদের ভাষার নাম দেওয়া হয়েছে সেন্টিনেলি ভাষা। মনে করা হয়, এটি আন্দামানি ভাষাগুলোর একটি। সেন্টিনেলিদের ধর্ম সম্পর্কে স্পষ্ট বা অস্পষ্ট কোনো ধারণাই পাওয়া যায় না। তাদের সংশ্লিষ্ট কোনো জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কেও তেমন জানা যায় না। তবে আন্দামানের আদিবাসী ‘ওঙ্গে’দের সঙ্গে এদের ভাষার কিছুটা মিল পাওয়া যায়। কিন্তু সেন্টিনেলি ভাষা তাদের সবচেয়ে কাছের উপজাতি ওঙ্গে’দের পক্ষেও বোঝা মুশকিল।
বিশ্বের অন্য যেসব উপজাতি আছে, তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এই উপজাতি। মনে করা হয়, এদের আদিপুরুষরা আফ্রিকা থেকে এই দ্বীপে এসেছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটাই সম্ভবত বিশ্বের শেষ উপজাতির আবাসস্থল; যাদের কাছে আমল পায়নি আধুনিক সভ্যতা। এখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার ধরনও জানে না কেউ।
দ্বীপটি প্রবাল প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। দ্বীপে রয়েছে ঘন সবুজ বনভূমি, বাসিন্দাদের ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর। দ্বীপটি ঘিরে রয়েছে একটি সংকীর্ণ সমুদ্র সৈকত। যার মহীসোপান-মহীঢাল ২০ মিটার থেকে ১২২ মিটার। দ্বীপের চারপাশের প্রবাল প্রাচীরগুলো ৪০০ থেকে ১২৯০ মিটার পর্যন্ত প্রসারিত। প্রায় চতুর্ভুজ আকারের দ্বীপটির আয়তন ৫৯.৬৭ বর্গকিলোমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় ১২২ মিটার। দ্বীপটির আনুমানিক লোকসংখ্যা ৫০ থেকে ৪০০ জনের মতো। ৬০ হাজার বছর ধরে দ্বীপটির বাসিন্দারা নিজেদের মতো করেই এখানে টিকে আছে।
১৯৭৫ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একজন চিত্রগ্রাহক তথ্যচিত্র বানানোর জন্য গিয়েছিলেন সেন্টিনেল দ্বীপে। উপজাতিদের বিষমাখানো তীরের আঘাতে তিনি মারাত্মক ভাবে জখম হন। ১৯৯০-এর দশকে বহিরাগতদের সঙ্গে দক্ষিণ ও মধ্য আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বসবাসরত জারাওয়া জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত একইরকম অভিযানে সৃষ্ট ধারাবাহিক আক্রমণে বেশ কিছু মানুষ প্রাণ হারান এবং অভিযানগুলো তখন বন্ধ করে দেওয়া হয়।
১৯৬৭ সালে থেকেই ভারত সরকার সেন্টিনেলিদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে যাচ্ছিল। ভারতীয় নৃতত্ত্ববিদ ত্রিলোক নাথ পণ্ডিতই প্রথমবার ১৯৯১ সালে দ্বীপটিতে নিজে গিয়ে সেন্টিনেলদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি। যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা হিসেবে দ্বীপটির তীরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপহার যেমন, খাবার, পোশাক ইত্যাদি রেখে আসা হতো। কিন্তু তাতে তাদের আদিম-হিংস্র মানসিকতায় কোনা পরিবর্তন আনা যায়নি। ২০০৪ সালে সুনামির পর হেলিকপ্টারে উত্তর সেন্টিনেল আইল্যান্ডে ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিল ভারত সরকার। তখনও ত্রাণ নেওয়ার বদলে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে অতর্কিতে পাল্টা আক্রমণ চালান তাঁরা। অবশেষে তাঁদের বিরক্ত না করার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত সরকার। ওই দ্বীপ এবং তার চারপাশে ৩ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সীমানা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
সম্প্রতি ২০১৮ সালের নভেম্বরে আমেরিকান মিশনারী জন আলেন চাউ আন্দামানের নর্থ সেন্টিনালে গিয়েছিলেন সেখানকার উপজাতিদের সম্পর্কে কিছু বিশদে জানবেন বলে| তিনি চেয়েছিলেন তাদের মধ্যে খৃষ্ট ধর্ম প্রবর্তন করতে| কিন্তু অবধারিতভাবে তিনি ওই উপজাতিদের দ্বারা নিহত হন| যদিও তিনি আইন মেনেই সেখানে গিয়েছিলেন কিন্তু নিজের প্রাণ রক্ষা করতে পারেননি|
তাই একথা বলা যায়, যে যেখানে সুন্দর তাকে সেখানেই থাকতে দেওয়া ভালো| আমরা নাই বা ঘাঁটালাম ওই সব জনজাতিদের| নাই বা জানলাম তাদের সম্পর্কে অনেক বেশি তথ্য়| যেটুকু জানতে পারছি, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে শিখি এবারে| সেন্টিনালের অধিবাসীদের তাদের মতই থাকতে দিই| সেটাই হবে তাদেরকে দেওয়া সবচেয়ে বড় সম্মান|