পোড়ো ভিটে। খোড়ো চাল। ভাঙ্গা দাওয়া। জংলা গাছের ঝোপ। আবছায়া ঢাকা বাঁশ বন। মেটে পথ দিয়ে হেঁটে যায় এক থুত্থুরে বুড়ি। বটের ঝুরির মত বলিরেখার দাগ তার চোখে-মুখে। আশ্বিনের কাশফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছটপটে গেঁয়ো চোখ চষে বেড়ায় মাঠঘাট, রেললাইন। ঝুপ্পুস হয়ে ভিজতে থাকে বৃষ্টিতে। জিভের ডগায় নোনা জলের স্বাদ।
সেসব ভারী হেলাফেলার গল্প। তবু তার গায়েই লেগে থাকে ভালবাসার খুদকুড়ো। কালবৈশাখীর ঝড়ে চাল উড়ে যায়। টিমটিম করে বেঁচে থাকে ভিটে। হোক না সে ঝোপঝাড়ে ঢাকা!
এক ঝড়ে বদলে তিনি দিয়েছিলেন ভারতীয় সিনেমার ভাষা। সিনেমা দেখার দৃষ্টি বদলে গিয়েছিল দর্শকদের। শুধু বাঙালি নয়। শুধু ভারতীয় নয়। আন্তর্জাতিক সিনেমাতেও এমন মাটির ভাষা বিরল। সেই ভাষায় কথা বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়। রেনেসাঁসের মানুষ।
বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালি কবে যেন সত্যজিতের হয়ে গিয়েছে। ভুবন জোড়া সাফল্যের সঙ্গে কিছু কটাক্ষপ্রাপ্তিও হয়েছিল অবশ্য। সমালোচকরা বলেছিলেন দেশের দারিদ্রকে বিদেশে বিক্রি করেছেন তিনি।
অভিনেত্রী নার্গিস তখন রাজ্যসভার সদস্য। তিনিও সমালোচনা করেছিলেন ‘পথের পাঁচালী’র। দারিদ্র প্রদর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে। এই সমালোচনার উত্তরে মুখ খুলেছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু। অধিবেশন চলাকালিন। বলেছিলেন, দারিদ্র দেখানোয় অসুবিধা কী আছে? গোটা বিশ্ব জানে আমরা গরীব। কিন্তু সত্যজিৎ রায় যেভাবে দেখিয়েছেন তাতে সৌন্দর্য আর সহমর্মিতা আছে।
শুধু সিনেমা নয়। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাঁর দর্শন ছিল একই। সহজ সরল মাটির ভাষা, নিজের ভাষা। ভাষা এমন হবে যা সকলে বুঝবে। চরিত্রদের মুখ দিয়েও এই কথাই বলিয়েছেন বারবার। কখনও গুগাবাবা কখনও বা চারু।
সিনেমার সত্যজিৎকে যতটা আলোচনা হয় সাহিত্যের সত্যজিৎকে ততটা নয়। ফেলুদা, শঙ্কু বা ছোটগল্পের সিরিজ অনুবাদ হলেও তাঁর লেখার একটা বড় অংশ অপ্রকাশিত থেকে গিয়েছে এখনও। সত্যজিতের লেখা অনুবাদের মাধ্যমে আরও বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে সোসাইটি ফ্র দ্য প্রিজারভেশন অফ সত্যজিৎ রায় ফিল্মস ওরফে রে সোসাইটির সঙ্গে চুক্তি করল পেঙ্গুইন র্যান্দম হাউস।
এই চুক্তিতে খুশি সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায়। জানিয়েছেন, সত্যজিৎ রায়ের কাজের কোন কোন বিষয় নিয়ে বই হতে পারে আপাতত তার পরিকল্পনা চলছে। সিনেমার স্টিল ছবি, বিজ্ঞাপন,এসবও তার মধ্যে আছে। তাঁর বহু লেখা এখনও অনুবাদের বাইরে। গল্প, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার। সত্যজিতের সমস্ত সৃষ্টি নিয়ে ছবি প্রধান একটা কফি টেবিল বই হতেই পারে।
শঙ্কু ও ফেলুদা নিয়ে লেখা উপন্যাসের প্রথম ইংরেজি অনুবাদ এই সংস্থাই প্রকাশ করেছিল।
পেঙ্গুইনেই তরফে পেংগুইন রান্ডাম হাউস ইন্ডিয়ার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, মার্কেটিং, ডিজিট্যাল ও কমিউনিকেশন্স নীতি কুমার গুরুগ্রাম থেকে এক ইমেইল সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, রে সোসাইটির সহযোগী হতে পেরে পেংগুইন গর্বিত। এই চুক্তি অর্থপূর্ণ এবং দীর্ঘস্থায়ী হোক তারা সেটাই চান। ইংরেজিতে অপ্রকাশিত সত্যজিৎ প্রকাশ করে পাঠকমহলে পৌঁছে দেওয়াই তাদের লক্ষ্য।
চুক্তির আরও একটা দিক রয়েছে। সত্যজিৎ বার্ষিক সত্যজিৎ রায় স্মারক বক্তৃতা এবছর থেকে যৌথ উদ্যোগে আয়োজন করবে পেঙ্গুইন। এবারের বক্তা বর্ষীয়ান পরিচালক তরুণ মজুমদার। সত্যজিৎ রায়ের লেখা চিত্রনাট্য, পাণ্ডুলিপি, তাঁর তৈরী ছবির পোস্টার, লবি কার্ড, স্কেচ, পত্রিকার প্রচ্ছদ, পুরস্কার, সংগীত স্বরলিপির মত বিপুল সৃষ্টির ভান্ডার সংরক্ষণের দায়িত্ব 'রে সোসাইটি'র। এই কাজে বিভিন্ন সময়ে তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন জোসেফ লিন্ডনার, ডেভিড শেফার্ড, মাইক হুইলারের মত বিশেষজ্ঞরা এবং দেশ বিদেশের কিছু সংস্থা। পাশাপাশি রে সোসাইটি সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে একযোগে প্রকাশ করেছে 'ডিপ ফোকাস', সত্যজিৎ রায়'জ রবিশংকর, দ্য পথের পাঁচালি স্কেচবুক, এবং 'সত্যজিৎ রায়: প্রবন্ধ সংগ্রহ'র মত কিছু উল্লেখযোগ্য বই ও। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৯৯২ সালে সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর এক বছরের মধ্যেই গঠিত হয় 'রে সোসাইটি'।