একাধিক বৈজ্ঞানিকের তত্ত্বাবধানে ইসরো (ISRO) ভারতীয় ও বিদেশী উভয়ের হয়েই বিভিন্ন রকম কাজ করে থাকে। ইসরোর উপগ্রহ উৎক্ষেপণের জন্য বিভিন্ন উৎক্ষেপন যান ও উৎক্ষেপণ স্থলও রয়েছে। ২০০৮ সালে ইসরো সফলতার সঙ্গে ‘চন্দ্রযান-১’ নামে চাঁদে মহাকাশযান পাঠায়। ভবিষ্যতের জন্য এই সংস্থা মনুষ্যচালিত মহাকাশ অভিযান, পুনরায় চন্দ্রাভিযান, এবং অন্যান্য গ্রহে অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
২০১৯ এর এপ্রিলে চাঁদে যাওয়ার কথা ছিল ‘চন্দ্রায়ণ-২'এর। ইজরায়েলে ব্যর্থতার মুখ দেখার পর ভারতীয় এই সংস্থা ISRO চন্দ্রাভিযানে সফল হওয়ার লক্ষ্যে জুলাই পর্যন্ত চন্দ্রায়ণ-২ এর উৎক্ষেপণ স্থগিত রাখে। উৎক্ষেপণের মাত্র ৫৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ড আগে কিছু যান্ত্রিক গোলযোগ সামনে আসায় সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করা হয় ISRO চন্দ্রাভিযান।
চন্দ্রায়ণ-২ উৎক্ষেপণ উপলক্ষ্যে সেখানে সেদিন উপস্থিত ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। সম্প্রতি এ ব্যাপারে ইসরো একটি টুইট করে জানিয়েছে, মাত্র ৫৬ মিনিট আগে চোখে পড়ে চন্দ্রায়ণ-২’তে কিছু যান্ত্রিক সমস্যা রয়েছে, সে কারণে এখনই চন্দ্রায়ণ-২ মহাকাশের দিকে যাত্রা করতে পারবে না। ইসরোর পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, রকেট থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ জ্বালানি লিক করছিল। তবে, পরে চন্দ্রযানটি ওড়ার জন্য তাতে সম্পূর্ণভাবে তরল হাইড্রোজেন গ্যাস ভর্তি করে দেওয়া হয়।
‘চন্দ্রায়ণ ২’ একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ চন্দ্রযান। শক্তিশালী রকেট লঞ্চার ‘জি এস এল ভি- এম কে ৩’, ২.৪ টনের একটি অরবিটার বহন করছে যা ১বছর -এর কাছাকাছি কাজ করার মতো ক্ষমতা রাখে।
'চন্দ্রায়ণ ২' যেখানেই অবতরণ করবে সেখানে গিয়ে তার প্রথম কাজই হবে জলের অস্তিত্বের অনুসন্ধান।
অবতরণের পরেই 'চন্দ্রায়ণ ২'-এর রোভার চাঁদের মাটির বিভিন্ন রাসায়নিক পরীক্ষা করবে।
ল্যান্ডার চাঁদের মাটির কম্পনমাত্রা খতিয়ে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ভূগর্ভের গঠনবৈচিত্র্য জানতে গর্ত খুঁড়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরিক্ষা চালাবে।
জলের অস্তিত্ব খোঁজার সঙ্গে সঙ্গে 'চন্দ্রায়ণ ২'-এর কাজ হবে চাঁদে প্রাণের বাসযোগ্য পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা।
২০২২ সালের মধ্যে মানুষ-সহ চন্দ্রযান-কে চাঁদে পাঠানোর জন্য জোর সওয়াল করেছেন নরেন্দ্র মোদী। সেই সঙ্গে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো একটি স্বল্পব্যায়ের মডেলও গড়ে তুলতে চাইছে। এতে মহাকাশ গবেষণায় আরও বেশি করে কাজ করা যাবে বলে মনে করছে ইসরো। এই কারণে মহাকাশযানের সঙ্গে পর্যটকদেরও মহাকাশ পাঠানোর পরিকল্পনাকে কার্যকর করতে চাইছেন তাঁরা।
এই অভিযান সফল হলে ভারত বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে নজির গড়বে। এর আগে আমেরিকা, রাশিয়া ও চিনের মতো দেশগুলি এই ধরনের নজির গড়েছে। এই দেশগুলি চাঁদের বুকে মহাকাশযান অবতরণ করিয়েছে। তবে, ভারত এ বার চাঁদের বুকে মহাকাশযান নামানোর সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি নজির গড়ছে। আর সেটি হল 'চন্দ্রায়ণ ২'-কে ইসরো অবতরণ করাচ্ছে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে।
এর আগে কোনও মহাকাশযান দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করেনি। 'চন্দ্রায়ণ ২'-এর অরবিটার, ল্যান্ডার, এবং রোভার এর মত সমস্ত যন্ত্রপাতির পরিকল্পনা থেকে শুরু করে, তৈরি সমস্তটাই হয়েছে ভারতে।
ইসরোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান এ এস কিরণ কুমার জানিয়েছেন, 'দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি একটা জায়গায় অবতরণ করবে চন্দ্রায়ন ২। যেখানে এখনও পর্যন্ত কেউই পৌঁছতে পারেনি। যখন কোনও নতুন জায়গায় পৌঁছোনো হয় তখনই সেখান থেকে নতুন কিছু আবিস্কারের একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। এবার আমরা এমনই একটা জায়গায় যাচ্ছি যেখানে আগে কখনো কেউ যায়নি।'
পূর্বে চিন থেকে শুরু করে রাশিয়া- চাঁদের উত্তর মেরুতে মহাকাশযানকে অবতরণ করিয়েছে। আমেরিকা তাদের মহাকাশযানগুলিকে অবতরণ করিয়েছে ইক্যুইটোরাল বা অক্ষরেখা অঞ্চলে। নাসা-র অ্যাপোলো মিশন যখন হয়েছিল তখনও দেখা গিয়েছিল চাঁদের ইক্যুইটোরাল অঞ্চলে অবতরণ করতে।
‘আইএসআরও’ মহাকাশ গবেষণার জন্য প্রথম তৈরি হয়েছিল বিক্রম সারাবাই এবং পদার্থ বিজ্ঞানী কল্পতি রামকৃষ্ণ রামানাথনের নেতৃত্বে, ১৯৬২ সালে।
মহাকাশ গবেষণা সংস্থা তাদের শুরুর দিনগুলো থেকে আজ পর্যন্ত একটা দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেছে।
কয়েকজন হাতে গোনা বিজ্ঞানী এবং সীমিত অর্থায়নের উপর নির্ভর করে তারা তাদের প্রথম রকেট লঞ্চ করে। আর আজ তার পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা চাঁদ, মঙ্গল ও তার বাইরেও রকেট পাঠাচ্ছি।
INSCOSPAR তৈরি হবার এক বছর পর ১৯৬৩ তে ভারতীয়রা প্রথমবার মহাকাশযান মহাকাশে পাঠায়। এটা শুরু হয়েছিলো কেরলের জেলেদের গ্রাম থুম্বা থেকে, যা ‘বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার’ নামে পরিচিত এখন।
ডক্টর এপি জে আবদুল কালাম সেইসময়ের রকেট লঞ্চের সেই দলটিতে ছিলেন। ১৯৬৩'র নভেম্বরের ২১ তারিখে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডক্টর হোমি ভাভা'র উপস্থিতিতে লঞ্চ হয় মহাকাশযানটি।
‘আর্যভট্ট’ মহাকাশযান নামকরণ করা হয়েছিল বিখ্যাত ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীর নাম অনুসারে। এটাই ছিল ভারতের প্রথম উপগ্রহ। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে ভারতেই পরিকল্পিত এবং গঠিত হলেও এটি ১৯৭৫ সালের ১৯ এপ্রিল লঞ্চ করা হয় ‘সোভিয়েত কসমস-৩ এম’ বোর্ডে।
১৯৮৮ সালে জুলাই মাসে শ্রীহরিকোটা ব্যাপ্তি থেকে রোহিনী স্যাটেলাইট আরএস-১ এর সাথে চালু করা হয়েছিল। এটা আনুষ্ঠানিকভাবে পৃথিবীর ষষ্ঠ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে যারা সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে মহাকাশযান নির্মাণে সক্ষম হয়েছে।
১৯৮৪ সালে ভারতীয় মহাকাশচারী রাকেশ শর্মা ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি যৌথ মিশনের অংশ ছিল। তিনি আট দিন রাশিয়ান স্পেস স্টেশন স্যাল্যুত ৭'-এর বোর্ডে কাটিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি মহাকাশে ছিলেন।
The modern-day ISRO workhorse, the Polar Satellite Launch vehicle ১৯৯৭ সালে তাদের প্রথম ‘ফ্লাইট’ তৈরি করে। আর তারপর থেকে রকেটের সংস্করণগুলি সব ধরনের উপগ্রহের কক্ষপথে ঢুকতে ব্যবহৃত হয়েছে।
এছাড়াও ১৯৯৯ সালে তিনটি ভিন্ন উপগ্রহের সাথে কক্ষপথের জন্য PSLV বোর্ডে লঞ্চ হয়। সেই দলে ছিলেন একজন ভারতীয়, একজন কোরিয়ান এবং একজন জার্মান। সাল ২০০১ এ প্রথমবারের জন্য Geo-synchronous Satellite Launch Vehicle (GSLV) লঞ্চ করতে দেখা গিয়েছিল। ১৮ বছর আগে এটা আমাদের স্যাটেলাইটকে দ্বিতীয় বারের জন্য চাঁদে নিয়ে গিয়েছিল।
২০০৭ এ আমরা প্রথমবারের জন্য স্পেস ক্যাপসুল পুনরুদ্ধারের পরীক্ষা(SRE 1) লঞ্চ করি। এটা এমন একটি পরীক্ষা ছিল যা পৃথিবীতে ফেরত আসার এবং পুনরুদ্ধারের আগে মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে সঞ্চালিত হয়। ২০০৮ এ চান্দ্রায়ণ ১ মিশনের সময় চাঁদের কক্ষপথের চারপাশে একটি উপগ্রহের খোঁজ পাওয়া যায়। যা পরবর্তীকালে চাঁদের মধ্যে জলের অস্তিত্ব সম্পর্কে একটা বিরাট আবিস্কার ছিল। ঠিক তার পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই ২০১৩ সালে ISRO মঙ্গলের দিকে দৃষ্টি দেয়। মহাকাশ সংস্থার পক্ষ থেকে লঞ্চ করা হয় মঙ্গলের কক্ষপথ মিশন ( Mangalyaan/Mars Orbiter Mission) যা অবশেষে ২০১৪ সালে মঙ্গলের কক্ষপথে ঢোকানো হয়। এখান থেকে কখনও কখনও তথ্য স্ট্রিমিং করাও সম্ভব হয়েছে।
আর এইমূহুর্তে চন্দ্রায়ণ ২ এর সাথে সাথে ISRO'র টুপিতে সংযোজন হয়েছে একটি নয়া পালক। এর সঙ্গে তারা লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে আনতে সক্ষম হয়েছে এক নতুন আশার আলো