“রথযাত্রা লোকারণ্য মহাধুমধাম, ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম”- রথের তাৎপর্য যে ভক্তদের কাছে কতটা তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত এই দুটি লাইনেই পরিস্ফুট। ভারত তথা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সগৌরবে পালিত হয় রথ উৎসব। তবে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা এক ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব। রথযাত্রা মিলনের উৎসব, বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন প্রান্তের লোক একত্রিত হন রথের দড়ি টেনে পুণ্য অর্জন করার উদ্দেশ্যে। এই দিন জগন্নাথদেব তাঁর ভাই বলরাম ও বোন সুভদ্রার সাথে রথে চড়ে যাত্রা করেন মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে। পুরীর রাজপথ ধরে এগিয়ে চলে তাদের রথ, হাজারো ভক্তের ঢল নামে প্রভুকে একবার দর্শনের জন্য।
১০৭৮ সালে প্রথম পুরীর মন্দির নির্মিত হয়, পরবর্তীকালে ১১৭৪ সালে এর সংস্করণ করা হয় এবং এখন এটিকে আমরা সেই রূপে দেখি। পুরীর এই রথের নেপথ্যে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক কাহিনী, অনেক অজানা তথ্যও।
- পুরীর মন্দিরের চূড়ায় যে সুদর্শন চক্রটি রয়েছে তা পুরীর যে কোনো জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে দেখলে তা দ্রষ্টা নিজের সামনেই দেখতে পাবেন
- পুরীর মন্দিরের চূড়ার পতাকাটি সবসময় বাতাসের বিপরীতে ওড়ে
- কোনো পাখি বা বিমান পুরী মন্দিরের উপর দিয়ে উড়তে পারে না
- মন্দিরের ছায়া কখোনোই দেখা যায় না, রৌদ্রোজ্জ্বল দিনেও সর্বোচ্চ প্রাসাদটির কোনো ছায়া কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না।
- পুরীর মন্দিরে ভক্তদের প্রসাদের কোনো অভাব কোনোদিন হয় না। ৫৬ রকমের জিনিস দিয়ে তৈরী করা হয় মহাপ্রসাদ। সারা বছরই সমপরিমাণ প্রসাদ রান্না করা হয়। ভক্তের সংখ্যা যতই হোক না কেন খালি হাতে কেউ ফেরে না মন্দির থেকে। আর কোনোদিন মন্দিরের খাবার নষ্টও হয় না।
- পুরীর মন্দিরে রান্নার জন্য যে কুঁয়ো থেকে জল সংগ্রহ করা হয় তাঁর জল বছর বছর ধরে ব্যবহারের পরেও শেষ হয়ে যায় না। পুরীর মন্দিরের এই রান্নাঘর পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম রান্নাঘর। একবারে এক লক্ষ মানুষের খাবার তৈরী হয় এই রান্নাঘরে।
- ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রা হল আমেদাবাদের রথযাত্রা, প্রায় ১৩০ বছরের পুরানো এটি।
- প্রতিবছর পুরীতে তৈরী করা হয় তিনটি নতুন কাঠের রথ। ২ মাস ধরে তৈরী হয় ৪৫ ফুট উঁচু ও ৩৫ বর্গফুটের এক একটি রথ। রথে ব্যবহৃত হয় ১২০০ মিটার কাপড়। চোদ্দ-পনেরো জন দর্জি মিলে তৈরী করেন এটি। রথ তৈরীর এই পর্ব চলে এক এক করে রথ বানানোর মাধ্যমে, একসাথে তিনটি রথ তৈরির কাজ কখোনো হয় না।
- প্রায় ১৪০০ জন শ্রমিক মিলে পুরীর রথ তৈরী করেন, আর এই কারিগর যে কেউ হতে পারেন না, প্রথম থেকে যারা রথ তৈরীর কাজে নিযুক্ত তারাই বংশপরম্পরায় করতে পারেন এইকাজ।
- এই বর্তমান প্রযুক্তির যুগেও কোনোরকমের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয় না রথ নির্মাণে। আর পুরো রথটিই হয় কাঠের, কোন ধাতুর ব্যবহার এতে হয় না, পেরেখও নয়। পরিমাপ করতেও ফিতে নয় এটিও হাত দিয়েই করা হয়।
- রথ নর্মাণে যে কাঠ সংগ্রহ করা হয় তার কাঠ সংগ্রহ করা হয় পুরী সংলগ্ন দাশপাল্লা ও রানাপুর নামক দুটি জঙ্গল থেকে। তবে শুধু গাছ কাটাই নয় এর সাথে গাছ রোপণ করাও হয়। যে পরিমাণ গাছ কাটা হয় তার দ্বিগুণ সংখ্যক গাছ লাগানোও হয়।
- রথের আগে পুরীর রাজা সোনার ঝাড়ু ও সুগন্ধি জল দিয়ে প্রতিটি রথ পরিষ্কার করেন। রথের দিন মোট ২০৮ কেজি সোনা দিয়ে সাজানো হয় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে।
- পুরাণমতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাঙ্গন থেকে শ্রীকৃষ্ণকে ফিরিয়ে আনতেই প্রথম তৈরী হয়েছিল রথযাত্রা।
- পশ্চিমবঙ্গের মাহেশের রথযাত্রার রয়েছে এক ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ। ১৮৭৫ সালে রথযত্রা পালিত যখন হচ্ছিল তখন ভীড়ে হারিয়ে যায় একটি বাচ্ছা, যাকে খুঁজতে পথে নেমেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সেই ঘটনার উল্লেখও রয়েছে রাধারাণী উপন্যাসে।
রথ শুধু ভারতেই নয়, বিশ্বজুড়ে পালিত হয়। ডাবলিন, প্যারিস, সিঙ্গাপুর, টরন্টো, নিউ ইয়র্ক, লস এঞ্জেলেস, মেক্সিকো তে পালিত হয় রথ। এই উৎসবের মাহাত্ম্য এতটাই যে ভারতের সীমা পেরিয়ে তা পৌঁছে গেছে সুদূর বিদেশে।