প্রতি বছরই শারদ উত্সবের শেষে কলকাতায় শুরু হয় আর এক উত্সব, কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব। থাকে রঙ্গীন আলোর ঝলকানি, উদ্বোধন করতে কলকাতায় পা রাখেন পৃথিবী কাঁপানো ফিলম স্টারেরা, থাকে অনেক বৈভব, কিন্ত থাকেনা কেবল একটাই জিনিস! জানেন কী সেটা? একটা আয়না, যে অদৃশ্য় আয়নায় দেখা যায় আত্ম-প্রতিকৃতি, নিজের অতীতের ইতিহাস যার কঙ্কালে পা দিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে একটি সমাজের বর্তমান এবং ভবিষ্যত। আয়না থাকলে হয়তো দেখা যেত এমনকিছু অতীত কে যা আমাদের সমৃদ্ধ করেছে, সেই রকমই এক অতীতের নাম সবিতাব্রত দত্ত। নায়ক! গায়ক! পরিচালক!, বাংলা অভিনয়ের জগৎ-এ যিনি এক বিরল প্রতিভা। ১৯৪৮এ পথচলা শুরু বহুরূপী হয়ে তারপর তিনিই হয়ে উঠলেন রূপকার, ততদিনে 'রক্তকরবীর' ছোঁয়া পেয়েছেন সবিতাব্রত, তারপরেই বাংলার মঞ্চজগৎ-এ পরিচালক সবিতাব্রতের আবির্ভাব। প্রথমে 'চলচিত্তচঞ্চরী' আর তারপরে 'ব্যাপিকা বিদায়',সবিতাব্রতের দুই জনপ্রিয় প্রযোজনা। ভারতবর্ষের মঞ্চাভিনয়ের মূল সুর যে তারে বাঁধা তাকে ছুঁতে পেরেছিলেন সবিতাব্রত দত্ত, উদাত্ত গলায় গান, দৃঢ় বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর,সাবলীল অভিনয় ক্ষমতা এই সমস্ত গুণই তাঁকে অনন্য করে তুলেছিল। তার অভিনীত সিনেমাগুলো হয়তো কারো মনে হতেই পারে যে খুব উঁচু দরের নয় কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার জায়গাই নেই যে এই উপমহাদেশে যে উদ্দেশ্যে সিনেমা তৈরি শুরু হয় সবিতাব্রতের অভিনীত সিনেমা চারনকবি মুকুন্দদাস ছিল তারই ফলশ্রুতি। চারনকবি মুকুন্দদাস সিনেমায় সবিতাব্রত দত্তের একই সাথে নাটকীয় এবং স্বাভাবিক সিনেম্যাটিক অভিনয় মনে দাগ কেটে যায়। এই সিনেমাতেই তিনি যখন মুকুন্দদাসের চরিত্রে মঞ্চের ওপর পা ঠুকে ঠুকে গাইছেন 'বন্দেমাতরম্ বলে নাচোরে সকলে কৃপাণ লইয়া হাতে' তখন যেন তার পায়ের আঘাত দর্শকদের বুকেই বেজে ওঠে। তবে ওনার অভিনীত শ্রেষ্ঠ সিনেমা অবশ্যই 'পথিক'। বাংলা ভাষায় দেশাত্মবোধক গান বললেই প্রথম নাম সবিতাব্রত দত্ত, এই ২০১৮তেও স্বাধীনতা দিবসে পাড়ার মাইকে তারই কন্ঠে শোনা যায় 'উঠো গো ভারতলক্ষী' অথবা 'মুক্তির মন্দির সোপানতলে'। ২০১৪ সালে দেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর গোটা দেশ জুড়ে দেশপ্রেমের নামে কী না হচ্ছে, বাংলাও তার থেকে বাদ নয়, কিন্তু এই তথাকথিত দেশপ্রেমিক নাগরিকরা সবিতাব্রত কে- তা জানেনই না। বর্তমানে যাঁরা চলচ্চিত্র বা ধারাবাহিকে অভিনয় করেন তাদের মধ্যে ৯০% মানুষও ওঁকে চেনেননা। সবিতাব্রতের হাত ধরেই একটা সময় বাংলা নাটকের গান অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল, ডি.এল. রায় কিম্বা অতুলপ্রসাদ বা রজনীকান্ত সমস্ত পথেই ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত, তাঁর নিজের বিভিন্ন নাটকের গানগুলোও ছিল অনবদ্য,তাঁর কন্ঠে 'পতিতোদ্ধারিনী গঙ্গে' শুনতে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন অনেক শ্রোতা, আর ওইরকম উদাত্ত গায়কিই বা আর কজনের ছিল?। আমরা যদি তাঁর এইরকম প্রতিভার ছোঁয়া পেতে চেষ্টা করি, তবে তাঁর সম্পর্কে আরও কিছু জেনে তাঁকে সেই প্রাপ্য মর্যাদা দিলেই, হবে তাঁর যথার্থ উত্তরসূরীর মত কাজ।