রাজধানীর দৈনন্দিন জীবনে কিঞ্চিত পরিবর্তন আনতে অভিনব দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন দিল্লীর দোকানদার রাজেশ কুমার শর্মা। দিল্লীর যমুনা ব্যাঙ্ক অঞ্চলের মেট্রো ব্রীজের নীচে একটি অস্থায়ী স্কুল স্থাপন করে, প্রায় ৩০০ জন দরিদ্র শিশুকে পড়াচ্ছেন তিনি। কোনো সহকারী, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা সরকারি সাহায্য ছাড়াই দীর্ঘ আট বছর ধরে একা হাতে শিশুদের বর্ণপরিচয়ের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন এই দোকানদার।
বস্তিবাসী, কাগজকুড়োনি, রিকশা চালক ও ভিক্ষুক পরিবার থেকে উঠে আসা তিনশোরও অধিক শিশুকে পড়িয়ে আসছেন ৪৯ বছর বয়সী এই স্বেচ্ছা-শিক্ষক। ব্রীজের নীচেই তার ক্লাস। আজ থেকে ১৩ বছর আগে যমুনার বুকে এক খোলা মাঠে উদাসীন ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই এই চিন্তা মাথায় আসে তার। ২ জন ছাত্র’কে নিয়েই সে সময় শুরু করে দেন আকাশের নীচে উন্মুক্ত স্কুল। বর্তমানে ২৪ ঘন্টায় দুটি শিফটে স্কুলটি চালান তিনি। ১২০ জন ছাত্রের জন্য সকাল ৯টা থেকে ১১টার ক্লাস এবং ১৮০ জন ছাত্রীর জন্য ২টো থেকে সাড়ে ৪টের ক্লাস বরাদ্দ থাকে।
মূলত ৪ থেকে ১৫ বছরের শিশুদের এই স্কুলে পড়ানো হয়ে থাকে। ঐ অঞ্চলের আরও ৭জন শিক্ষক তাদের অবসর সময়ে স্কুলে এসে ক্লাস করিয়ে যান। অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য বি.এসসি পড়তে পড়তেই কলেজ ছাড়েন রাজেশ কুমার। প্রতি সপ্তাহে ৫০টি মূল্যবান ঘন্টা শিশুদের প্রতি উৎসর্গ করা স্কুল এই প্রতিষ্ঠাতা মনে করেন, দারিদ্রের কারণে একজনেরও শিক্ষা এবং স্বপ্নপূরণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া উচিৎ নয়। শুরুটা একা হাতে করলেও, এখন লক্ষী চন্দ্র, শ্যাম মাহাতো, রেখা, সুনীতা, মনীষা, চেতন শর্মা’রা স্বেচ্ছায় ও বিনা পারিশ্রমিকে স্কুল চালাতে সহযোগিতা করে থাকেন।
১৩ বছরের এই অভিযানে সরকারি প্রতিনিধিদের তরফ থেকে কোনোরকম সাহায্যের হাত এগিয়ে আসেনি। যদিও এ নিয়ে কারো বিরুদ্ধেই ক্ষোভ নেই তার। “দুস্থ-দরিদ্র শিশুদের শিক্ষিত করার নিষ্কাম কর্মের দ্বারা আমি তাড়িত ছিলাম, তাদের হাসি আমার কাছে জগতের যে কোনো কিছুর থেকে অধিক মূল্যবান। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আমাদের সাথে যোগাযোগ করে স্কুলটির সাথে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সন্দেহজনক মনে হওয়ায় আমি তাদের অনুমতি দিই নি। শিশুদের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ-এর বিষয়টিকে কেউই তেমন গুরুত্ব দেন নি। আসলে তারা সকলেই একটা কিছু দেখিয়ে অন্য আরেকটি কিছু দাবি করে পয়সা রোজগারের তালে ছিলেন।”
সরকারি বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নয়, শুধুমাত্র স্বতন্ত্র ব্যক্তিদের থেকে অকৃত্রিম অনুদানের ক্ষেত্রে অনুমতি প্রদান করেন রাজেশ। মাঝে মধ্যে কিছু মানুষ এসে শিশুদের সাথে সময় কাটিয়ে যান। বিস্কুট, ফল, জলের বোতল, প্যাকেজড্ ফুড ইত্যাদি দান করে যান স্কুলে। কেউ কেউ ব্রীজের তলায় একত্রে বসে কেক কেটে-খাওয়া দাওয়া করে নিজেদের জন্মদিন পালন করে যান শিশুদের সাথে। এই দিনগুলিতে বাচ্চাদের সমাজের অঙ্গ বলেই মনেই হয়, এ সব ক্ষেত্রে তারা কোথায় থাকে অথবা কি তাদের পরিচয়, সে সব কোনো অংশেই খাটে না।
উন্মুক্ত স্কুলে ক্লাস করতে আসা ৬ বছরের ছোট্ট সুনীতার কথায়, এখানে শিখতে আসাটা খুব মজাদার। যতটা সম্ভব নিয়মিত ক্লাসে আসার চেষ্টা করি। জীবনে মহৎ কিছু অর্জন করার জন্যই রোজ দুপুরে আমি স্কুলে চলে আসি। মাঝে মাঝে আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে স্কুল বন্ধ থাকলেও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ একইরকম থাকে।