আমি আদ্যন্ত খাদ্যরসিক ঘরানার মানুষ। পরিমানে যাই হোক, যেকোনও খাদ্যবস্তুকেই হতে হবে স্বাদে-গন্ধে-রূপে একেবারে 'জেনুইন' -এই হল আমাদের ঘরানার আদর্শ। বঙ্গবাসী হওয়ার সুবাদেই বোধহয় এখনও এই ভাবাদর্শে আস্থা রাখতে পারি। ৯'এর দশকে মফস্বলে জন্ম নিতে পারার সুবাদেই খাঁটি জিনিস কেমন হয় তা এখনও চোখে- জিভে-মনে পুঙ্খানুপুঙ্খ লাগিয়ে রেখেছি। 'খাঁটি' স্বাদ কালের নিয়মে মুছে যায় তা জানা কথা, তাই সব থেকে ভাল উপায় যা কিছু ভালো তা মেমোর্যান্ডাম এ 'পুঙ্খানুপুঙ্খ লাগিয়ে রাখা' আর আজীবন তা ভাঙিয়ে খাওয়া। তবে ভরপুর আবেগতাড়না এবং পরীক্ষামূলকভাবে আমি এ কথা হলফ করে জানি যে, ভেজাল-গেরোর ফাঁদে পড়েও এই বর্তমান বাংলায় এখনও মেলে 'জেনুইন' স্বাদ।
কিছুদিন আগেই আদি কলকাতার সবথেকে পুরনো বাজার- 'নতুন বাজার'-এর দু'শো বছরের ঐতিহাসিক 'মাখনলাল এন্ড সন্স'-এর মিষ্টির প্রভূত তারিফ করছিলেন আমার ইউনিভার্সিটির একজন প্রিয় মাস্টারমশাই। মিষ্টির মধ্যে বিভিন্নরকমের সন্দেশ আমার রসনার মনিকোঠায় ঠিক কীভাবে অবস্থান করে তা বর্ণনাতীত। মাখনলাল-এ নাকি সবই 'শুকনো' অর্থাৎ সন্দেশ, কোনওটা কড়া, কোনওটা নরম। ব্যবহার করা হয় খাঁটি দুধ-ছানা। স্যারের এহেন বর্ণনা শুনে প্রথমেই মনে হয়েছিল এতদিন হল শহরনিবাসী হয়েছি, অথচ এ স্বাদ চেখে দেখিনি, এ বড় অন্যায় কথা। সেই অন্যায়ের বোঝা কত শীঘ্র ঘাড় থেকে নামানো যায় এ দুশ্চিন্তা নিয়েই সেদিন মাখনলাল-এ পৌঁছালাম সরেজমিন রসনা-তদন্তে। সে কী কান্ড! গিরীশপার্ক মেট্রো থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে নতুন বাজারের দিকে এগোচ্ছি আর দেখতে পাচ্ছি চার পুরুষ ধরে চলা ১৭৫ বছরের পুরাতন অধুনা বেশ ঝকঝকে ‘নলীন চন্দ্র আ্যান্ড সন্স’- এর উপচে পড়া ভিড়, আরও এগোতেই চোখে পড়ল 'কে সি দাস এন্ড সন্স'-এর কঙ্কাল, ভয় পাবেন না, 'কে সি দাস এন্ড সন্স' বহাল তবিয়তেই রয়েছে; যে কঙ্কালের কথা বলছি তা রবীন্দ্র সরণীর উপর প্রতিষ্ঠিত আদি 'কে সি দাস এন্ড সন্স', পরবর্তীকালে যেখান থেকে দোকানটি স্থানান্তরিত করা হয়।
(রবীন্দ্র সরণীর আদি ‘কে সি দাস এন্ড সন্স’)
এসব কিছু দেখছি আর আমার গন্তব্য কল্পনা করতে করতে ভাবছিলাম আর একটু এগোলেই বোধহয় দেখতে পাব দু'শো বছরের পুরনো 'অধুনা বেশ ঝকঝকে' মাখনলাল এন্ড সন্সে উপচে পড়ছে ভিড় আর আমি অর্ডার করছি বাহারি গালভরা সব সন্দেশ। এক স্থানীয় দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম 'মাখনলাল আর কতদূর?'। বললেন, আমি সামান্য এগিয়ে এসেছি। বললাম, 'আমি তো দেখতে দেখতেই হাঁটছিলাম, কই চোখে পড়ল না তো!'। বললেন, 'রাস্তার উপরে নয় তো, বাজারের ভিতরে ঢুকতে হবে।' বললাম, 'ও আচ্ছা, ধন্যবাদ'। ঢুকলাম 'পুরনো' নতুন বাজারের ভিতর। গলির রন্ধ্রে রন্ধ্রে কাঠ-পিতল-কাঁসা-আল্যুমিনিয়াম-লোহা ইত্যাদি সরঞ্জামের সারিবদ্ধ দোকান টপকে আমি পৌঁছালাম এক মিষ্টির দোকানে। নতুন বাজারের পুরনো 'হ্যাল' তো ছিলই, সে দোকান দেখে মনে হল আমি দু'শো বছর আগের টাইমলাইনে পৌঁছে গিয়েছি। শো'কেস নয় সে দোকানে মার্বেলের মেঝেতে বিছানো মাদুরে সুরূপা সব সন্দেশ গোছানো রয়েছে পেল্লায় সাইজের দু'চারটে কাঠ আর কাঁসার থালায়, ব্যাস। পাশেই কর্মচারীরা শশব্যস্ত ছানায় পাক দেওয়ায়। সবকিছুই চলছে আড়ম্বরহীন ভাবে।
এসব দেখে শুনে মিষ্টি খাওয়ার কথা ভুলে প্রথমটায় খানিক থতমত খেয়ে গেছিলাম। সম্বিত ফিরে পেয়ে সব জেনেশুনেই বলে ফেললাম 'রসের মিষ্টি করেন না আপনারা?' এক কর্মচারী উত্তর দিলেন- 'না, শুধু কড়া আর নরম পাক'। পারিজাত, চকোলেট, দিলখুশ, নতুন বাটার স্কচ, ব্ল্যাক কারেন্ট -কত কী বাহারি নাম তাদের। থালায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে পছন্দসই দুটো সন্দেশ দিতে বললাম। দিলেন। তারপর ... আহা..আ...হা....কী খাইলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না! দিন দাদা, আরো দু'টো চকলেট আর গোকুল সন্দেশ। খেতে খেতেই হিসেবে বসা মালিকপক্ষের উদ্দেশে বললাম, 'দোকানটা তো প্রাচীন হয়েছে, আপনারা কখনও আর পাঁচটা দোকানের মতো নতুন করে সাজানোর কথা ভাবেন নি?'। বললেন, 'আমার প্রপিতামহর হাতে তৈরী এ দোকান, বদল যে কিছু হয়নি তা নয়, তবে যৎকিঞ্চিত। বাজারের ভিতরের অতকিছু করেই বা কি হবে? সাউথে, বালিগঞ্জ কালচারালের কাছে অবশ্য একটা সময়োপযোগী শাখা হয়েছে আমাদের।' বললাম, 'এখানে বাজারের ভিতরে খরিদ্দার হয়?'। বললেন, 'হ্যাঁ হয়। সুনামে হয়। তাছাড়া এতবছরের পুরনো দোকানের পুরনো খরিদ্দারও তো রয়েছেন প্রচুর।' ওনার কথার সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখের সন্দেশও শেষ হল। দাম মেটাতে গিয়ে তো আর এক বিস্ময়! যা দাম নিলেন তাতে এ কালে আপনার অস্বস্তি বোধ হওয়াটাই সমীচীন। 'তিন' টাকার মিষ্টি এখনও মেলে?? ফেরার পথে 'মনোলগ' ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল এই কাঙ্খিত প্রশ্ন আর তৎক্ষণাৎ মেমোর্যান্ডাম এ পুঙ্খানুপুঙ্খ লেপ্টে নিয়েছিলাম দু'শো বছরের 'মাখনলাল এন্ড সন্স'-এর ঐতিহাসিক স্বাদ-গন্ধ-রূপ; এক্কেবারে 'জেনুইন'।