বড় ভাইয়ের বাহন ময়ূর আর ছোটভাইয়ের ইঁদুর

স্বর্গের ইন্দ্রপুরি। ইন্দ্রসহ বিভিন্ন দেবতারা সভায় উপস্থিত। ক্রঞ্চ নামের এক গান্ধর্ব ছিলেন। তিনি নিয়মিত গান শুনিয়ে সকলের মনোরঞ্জন করতেন। একদিন সেই সভায় উপস্থিত হলেন বামদেব নামের এক ঋষি। সভার মনোরম পরিবেশ আর সঙ্গীত-নৃত্যের পরিবেশ দেখে তাঁর গান গাইতে ইচ্ছে করল। যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। বেসুরো গলায় গান গাইতে শুরু করলেন।

তাঁর বেসুরো গলায় গান শুনে বিরক্ত হলেও সবাই চুপ করে ছিল। মুনিবর বলে কথা। পাছে যদি সাপ দিয়ে দেন। ক্রঞ্চ সভার মধ্যে হেসে ওঠেন। ঋষিবর সেই হাসি দেখে ক্রোধান্বিত হয়ে পড়েন এবং অভিশাপ দেন। ক্রঞ্চ আর কোনদিন গান গাইতে পারবে না এবং ইঁদুর হয়ে যাবেন। অভিশাপ শুনে ক্রঞ্চ আকুতি মিনতি করে শাপ থেকে মুক্তির উপায় জানতে চায়। মুনিবর বলেন গণেশ যদি তাঁকে বাহন করেন তাহলেই শাপ মুক্তি ঘটবে। নচেৎ নয়।

মর্ত্যে এসে ক্রঞ্চ ইঁদুররূপী ক্রঞ্চ পরাশর মুনির কুটিরে আশ্রয় নিলেন। ইঁদুরের উৎপাতে আশ্রমের সবাই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। সেই সময় গণেশ সেখানে এলে আশ্রমের সবাই ইঁদুরের উৎপাতের কথা জানায়। গণেশ ক্রঞ্চরূপী ইঁদুরকে ধরে ফেলেন। বন্দী ক্রঞ্চ নিজের পরিচয় দেন এবং শাপ মুক্তির কথা জানান। তারপর থেকেই ইঁদুর গণেশের বাহন হয় বলে কথিত আছে।

অন্যদিকে সমাজবিদরা মনে করেন বিভিন্ন সময়ে আর্যরা এদেশে এসেছেন। এখানকার অনার্য আদিবাসীদের সঙ্গে তাঁদের সংস্কৃতির আদান-প্রদান ঘটেছে। গণেশ অনার্য দেবতা। পরবর্তীকালে আর্য দেবতা হিসেবে উত্তরণ ঘটে। অনার্য গোষ্ঠীর প্রতীক ছিল হয়তো হাতি। সেইরকম ইঁদুরও কোন অনার্য গোষ্ঠীর টোটেম। পরে তা গণেশের পদতলে বাহন হিসেবে বা যুদ্ধে পরাজিত জাতির প্রতীক হিসেবে প্রদান পেয়েছে।

সংস্কৃত শব্দ "মুষ" শব্দ থেকে "মূষিক" শব্দের উৎপত্তি। মুষ শব্দের অর্থ লুঠ বা চুরি করা। সাঙ্কেতিকভাবে মানুষের মস্তিষ্ক মূষিক এবং স্বার্থপর। ইঁদুরের ওপর গণেশের বিরাজ করার অর্থ, স্বার্থকে পরাজিত করে জনকল্যাণ করা।

কার্তিককে ময়ূর উপহার দিয়েছিলেন ভগবান বিষ্ণু বলে কথিত রয়েছে। কার্তিকের সাধন ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে নারায়ণ তাঁকে এই বাহন দেন। ময়ূর সদা সতর্ক এবং আলস্যহীন। ময়ূরের স্বজন প্রীতিও লক্ষণীয়। সৈনিক কার্তিকও ময়ূরের মতো অনলস ও কর্মকুশল। ময়ূরপুচ্ছ শুধু সুন্দরই নয় তা ঢাল হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। ময়ূর হিংসতার প্রতীক। সাপের সঙ্গে ময়ূরের যুদ্ধ কৌশল লক্ষণীয়। এই কারণে হয়তো দেবসেনাপতি কার্তিকের বাহন ময়ূর।

কার্তিক আবার দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে মুরুগান নামে পরিচিত। এখানে মুরুগানের একটি উপাসক গোষ্ঠী ছিল বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। তাঁদের গোষ্ঠী প্রতীক ছিল ময়ূর। এছাড়া উত্তরপশ্চিম ভারতের হরিয়ানা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এক রণনিপুণ গোষ্ঠী ছিল। তাঁদের উপাস্য দেবতাও কার্তিক এবং গোষ্ঠীর প্রতীক ময়ূর। সেখান থেকেই কালানুক্রমে ময়ূর কার্তিকের বাহন হয়ে উঠেছে বলে মনে করা হয়।

তত্ত্ব কথা যাই থাকুক। গণেশ আর কার্তিক বাঙালির বড়োই আপনজন। তাঁরা এখন ঘরের ছেলে। বছরে চারদিন মায়ের সঙ্গে মামা বাড়ি ঘুরতে আসেন। তাই তাঁদের আদর যত্নের যাতে কোন রকম খামতি না থাকে সেদিকে সবারই তীক্ষ্ণ নজর।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...