২১ শতকে পৌঁছেও পৃথিবীতে এখনও এমন বহু মানুষ আছেন, যারা বেঁচে থাকার জন্য ক্রমাগত খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন। যুদ্ধপীড়িত দেশগুলিতে এ ধরণের ধারাবাহিকতাই দৃশ্যমান। সেখানকার অবস্থা এতই বিদীর্ণ যে তা আমাদের বোধে শিহরণ জাগিয়ে তোলে। এবার সেই ‘শিহরণ জাগানো’ অবস্থার বেশ কিছু ছবি জনসমক্ষে তুলে ধরতে এক অভিনব শিল্প নির্মাণ করে চলেছেন তুর্কির বাসিন্দা উগার গ্যালেনকাস।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলিতে যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থার ছবির সঙ্গে পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলির ‘কম্ফোর্ট লাইফ’-এর ছবির ‘জাক্সটাপজিশন(দুটি ছবিকে পাশাপাশি রাখা)’ ঘটিয়ে অদ্ভুত এক কোলাজ তৈরী করছেন তিনি। ইতিমধ্যেই তাঁর ছবিগুলি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। তাঁর ছবিগুলোতে প্রধাণত দু’টি ইমেজ থাকে। কম্পোজিশন এক থাকলেও একটি ছবিই বলে চলে দুটি বিপরীত কাহিনী।
যেমন, একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে এক মার্কিনী সৈন্যকে, যিনি নির্দয় ভাবে এক নিরীহ নাগরিক কে পা দিয়ে আঘাত করছেন। তার পাশেই আরেকটি ছবি, যেখানে ঐ একই কায়দায় একজন ফুটবলার ফুটবলে লাথি মারছে।
গোটা পৃথিবীতে ঘটে চলা বিস্তীর্ণ ঘটনাই তার ছবির প্রধান বিষয়বস্তু। যুদ্ধ, মন্বন্তর, নারী নিগ্রহ, আয় বৈষম্যের মতো ঘটনাগুলির উপর ভিত্তি করেই মূল রূপ পায় তাঁর ছবিগুলি। একটি ছবির কাঠামোতেই দুটি বিপরীতধর্মী ছবির মিশেল ফুটে ওঠে।
মূলত এই পৃথিবীর বাইরেও যে আরও একটি সমান্তরাল পৃথিবীর অস্তিত্ব আছে, যেখানকার অবস্থা সুখের তো নয়ই, বরং তা যে আরও ভয়ংকর, সে সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করে তুলতেই মূলত এই উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।
“গোটা পৃথিবীকে আমি বলতে চাই যে, উন্নত দেশগুলিতে মানুষেরা এখনও যুদ্ধ, ক্ষুধা ও যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে বসবাস করছে। শান্তি ও ঐক্যের সাথে বাঁচতে হলে আমাদের অবশ্যই পরস্পরের জীবন সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান থাকা আবশ্যক,” বলছেন ২৯ বছরের উগার।
কিন্তু হঠাৎ এই অভিনব চিন্তা এলো কোথা থেকে?
২০১৬ সালে তুর্কির এক সমুদ্রসৈকতে ভেসে আসা ৩ বছরের সিরিয়ান শিশু আলান কুর্দির মৃতদেহের ছবি গোটা দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দিয়েছিল। একুশ শতকে দাড়িয়েও রিফিউজিদের অবস্থা এবং তার ভয়াবহ পরিণতি আরও একবার বিশ্ব আঙিনায় তুলে ধরেছিল সেই ছবি। ছবিটি নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়েই প্রথম এই উদ্যোগটি নেন গ্যালেনকাস।
“একদিন সকালে খবর দেখার সময়, দেখলাম ভীষণ সন্ত্রস্ত অবস্থায় এক দল রিফিউজি, সুস্থ জীবনের প্রত্যাশায় নদী পেরোনোর চেষ্টা করছে। আমি ওদের চোখে ভয় ও হতাশা দেখেছিলাম। এই ঘটনা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর ঠিক করেছিলাম সমগ্র বিশ্বের কাছে আমি এই ঘটনাগুলোই তুলে ধরবো।“ বলছেন ইস্তানবুলের এই শিল্পী।
‘ইরাক, সিরিয়া ও ইরানের যুদ্ধ এবং তাঁদের প্রতিকূল পরিস্থিতি আমার কাজগুলিতে গুরূত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে।“ বলছেন শিল্পী।
যুদ্ধ মনোভাবাপন্ন চিন্তার অবক্ষয় ঘটাতে গেলে প্রথমেই দরকার যথাযথ শিক্ষার। পুঁথিগত না হলেও, অবশ্যই তাকে সনাতন হতে হবে, যার মধ্যে দিয়ে শিশুরা বেঁচে থাকার প্রকৃত অর্থ খুঁজে পাবে। বন্দুকের বদলে তারা কবিতা তুলে নেবে, ঘৃণা ও প্রতিহিংসাকে ব্যঙ্গ করে প্রেম ও সমতার গোলাপকুঞ্জ গড়ে তুলবে, আর উগারের মতো আমরাও আশা রাখতে পারি, ক্রমাগত এই নান্দনিক অনুশীলনের ফলে হয়তো অচিরেই একদিন পৃথিবীতে ঐক্য ও সমতা বিরাজ করবে। সাম্য এসে পড়বে, নির্বিঘ্নে।